দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, স্পিকার নারী, বিরোধীদলীয় নেতাও নারী। কোথাও পিছিয়ে নেই নারীরা। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টেও দ্যুতি ছড়াচ্ছেন নারীরা। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ১০ হাজার ৩৬৩ সদস্যর মধ্যে এক হাজার ৭৩৭ নারী আইনজীবী।

রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী। উচ্চ আদালতের বিচারকের মতো কঠিন দায়িত্বেও আছেন নারী। বর্তমানে সর্বোচ্চ আদালতে সাতজন নারী বিচারপতির আসন অলংকৃত করছেন। এর মধ্যে একজন আপিল বিভাগের বিচারপতিও রয়েছেন। তারা প্রত্যেকেই স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। 

বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ

বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ গত ৯ জানুয়ারি  সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি আপিল বিভাগের তৃতীয় নারী বিচারপতি।

১৯৫৫ সালের ১০ অক্টোবর বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ রাজবাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। ১৯৮১ সালের ৮ ডিসেম্বর জুডিশিয়াল সার্ভিসে মুনসেফ হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৯৮ সালের ১ নভেম্বর পদোন্নতি পান জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে।

১২ বছর জেলা জজ হিসাবে দায়িত্ব পালনের পর ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। দুই বছর দক্ষতার সঙ্গে অতিরিক্ত বিচারকের দায়িত্ব পালনের পর তাকে স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভাড ল’ স্কুলে সার্টিফিকেট কোর্সে অংশ নেন বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ। ১৯৯৬ সালে কানাডায় অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল উইমেন জাজেস অ্যাসোসিয়েশনের সম্মেলনে যোগ দেন। ২০১২ সালে যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল উইমেন জাজেস অ্যাসোসিয়েশনের সম্মেলনে।

বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী

বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরীর বাবা সাবেক বিচারপতি এ টি এম মাসুদ। ১৯৮১ সালের ২২ আগস্ট তিনি ঢাকা জেলা জজ আদালতে আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৮৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। পরে ১৯৯৬ সালের ১৪ মে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন তিনি। ২০০২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তাকে হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। দুই বছর পর ২০০৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনি হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।

বিচারপতি ফারাহ মাহবুব

বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ও এলএলএম পাসের পর ১৯৯২ সালে জেলা আদালতে আইন পেশা শুরু করেন। ১৯৯৪ সালের ১৫ অক্টোবর হাইকোর্টে এবং ২০০২ সালের ১৫ মে আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ২০০৪ সালের ২৩ আগস্ট তিনি হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি নিযুক্ত হন। ২০০৬ সালে তিনি হাইকোর্ট বিভাগে পূর্ণাঙ্গ বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। তার আরও একটি পরিচয় তিনি সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমানের মেয়ে। 

আজিমপুর কবরস্থান রক্ষার রায়, ধর্ষণের শিকার নারীদের দ্রুত মামলা নেওয়ার বিষয়ে নীতিমালা করে রায়, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রথাগত অধিকার রক্ষার রায়, অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যুর ঘটনায় শিশু জিহাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের রায়সহ অসংখ্য আলোচিত রায় দিয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন তিনি।
 
বিচারপতি নাইমা হায়দার

সাবেক প্রধান বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীর মেয়ে বিচারপতি নাইমা হায়দার। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। এছাড়া, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কেল বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৮৯ সালে জেলা আদালতে আইন পেশায় যোগ দেন নাইমা হায়দার । ১৯৯৩ সালে হাইকোর্টে আইনজীবী এবং ২০০৪ সালে আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ২০০৯ সালের ৬ জুন তিনি হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন। ২০১১ সালের ৬ জুন হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। বিচারপতি নাইমা হায়দার অসংখ্য আলোচিত রায় দিয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন।

বিচারপতি কাশেফা হোসেন

অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মোহাম্মদ হোসেনের মেয়ে বিচারপতি কাশেফা হোসেন। তিনি ইংরেজি বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়া লন্ডনেও একই বিষয়ে পড়াশোনা করেন। এরপর ১৯৯৫ সালে জেলা আদালতে আইন পেশায় যোগ দেন।

 ২০০৩ সালে হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন কাশেফা হোসেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তা ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালের ৪ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। ২০১৫ সালের ৫ আগস্ট তিনি হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।

বিচারপতি ফাতেমা নজীব

নরসিংদীর জেলা ও দায়রা জজ বেগম ফাতেমা নজীব ২০১৮ সালের ৩০ মে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।  ২০২০ সালের ৮ জুন তাকে স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

বিচারপতি কাজী জিনাত হক

একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষা সৈনিক সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কাজী এবাদুল হক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. শরীফা খাতুনের কনিষ্ঠ কন্যা বিচারপতি কাজী জিনাত হক। তিনি দুই মেয়াদে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর কাজী জিনাত হক হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।

আইনাঙ্গনে নারীদের দৃপ্ত পদচারণা নিয়ে কথা হয় উচ্চ আদালতের প্রথম নারী বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, উচ্চ আদালতে নারী বিচারপতির সংখ্যা আনুপাতিক হারে কম। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে আরও নারী বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া উচিত। আরও নারী বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হবে, নারী দিবসে এটাই আমার প্রত্যাশা। সেদিন বেশি দূরে নয় একদিন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতিও হবেন নারী।

এমএইচডি/আরএইচ