জরুরি বিভাগ সার্বক্ষণিক চালুর নির্দেশনা : হাইকোর্টে প্রতিবেদন
দেশের সকল হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ইনস্টিটিউটে জরুরি বিভাগ সার্বক্ষণিক চালু রাখার নির্দেশনা দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সার্কুলার ও এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করা হয়েছে।
মঙ্গলবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চে এফিডেভিট আকারে এই প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। প্রতিবেদনে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের জন্য কি কি যন্ত্রপাতি বরাদ্ধ করা হয়েছে তার তালিকা সংযুক্ত করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
এদিন আদালতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস। রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম। আদালত পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ২৮ মার্চ দিন ধার্য করেন।
ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেশের সকল হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ইনস্টিটিউটে জরুরি বিভাগ সার্বক্ষণিক চালু রাখাসহ কয়েকটি নির্দেশনা দিয়ে সার্কুলার জারি করেছেন। সেই প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়েছে। প্রতিবেদনে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের জন্য যেসব যন্ত্রপাতি দেওয়া হয়েছে, তার একটি তালিকা দিয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
রাশনা ইমাম বলেন, বাংলাদেশের যত সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকে জরুরি বিভাগ আছে, তার একটি তালিকা এবং জরুরি বিভাগগুলো কি অবস্থায় আছে, কি কি যন্ত্রপাতি আছে, কত জনবল আছে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আদেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। তবে এ বিষয়ে প্রতিবেদনে কোন তথ্য জানানো হয়নি। বিষয়টি আদালতের নজরে এনেছি। আদালত সার্বিক বিষয়ে আগামী ২৮ মার্চ বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া আদালতের কোনো কোনো আদেশ বাস্তবায়ন হয়নি এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন এফিডেভিট আকারে আমাদেরও দাখিল করতে বলেছেন।
এদিকে হাইকোর্টের নির্দেশে ২০২২ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. মো. ফরিদ হোসেন মিঞা স্বাক্ষরিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জারি করা সার্কুলারে বলা হয়েছে, সকল হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ইনস্টিটিউটে জরুরি বিভাগ সার্বক্ষণিক চালু থাকতে হবে। জরুরি যে কোনো রোগীর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। প্রাথমিক সেবাদানের পর প্রযোজ্য ক্ষেত্রে রোগীকে নিকটবর্তী হাসপাতালে রেফার করা যেতে পারে। জরুরি বিভাগে কমপক্ষে একজন চিকিৎসক, একজন সেবিকা, একজন স্বাস্থ্যসেবা সহায়তাকারী উপস্থিত থাকতে হবে। জরুরি সেবাদানের জন্য একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার, একটি নেবুলাইজার মেশিন এবং একটি ইসিজি মেশিন থাকতে হবে।
এর আগে ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর জরুরি চিকিৎসাসেবা দিতে কোনো হাসপাতাল অসম্মতি জ্ঞাপন করতে পারবে না বলে আদেশ দেন হাইকোর্ট। আদেশে বলা হয়, ‘কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে যখনই হাসপাতাল বা ক্লিনিক অথবা চিকিৎসকদের নিকট আনা হয়, উক্ত অসুস্থ ব্যক্তির তাৎক্ষণিক জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অসম্মতি জ্ঞাপন করতে পারবে না।’
আদেশে আরও বলা হয়, ‘যদি কোনো হাসপাতাল বা ক্লিনিকে এরূপ জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ব্যবস্থা না থাকে, সেক্ষেত্রে জরুরি সেবাসমূহ বিদ্যমান রয়েছে এমন নিকটস্থ কোনো হাসপাতালে উক্ত ব্যক্তিকে প্রেরণ করতে হবে।’
এছাড়া সব বেসরকারি-সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের তালিকা, জরুরি চিকিৎসাসেবা বিভাগ রয়েছে এমন হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর পৃথক তালিকা এবং সেসব হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহের জরুরি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বর্তমান অবস্থার বিস্তারিত বিবরণসহ একটি তালিকা তৈরির নির্দেশ দেন আদালত।
অসুস্থ ব্যক্তিকে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দিতে অসম্মতি জ্ঞাপন কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধেও রুল জারি করেন আদালত। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকের নতুন লাইসেন্স ইস্যু করার সময় এবং বিদ্যমান রেজিস্টার্ড হাসপাতাল বা ক্লিনিকের লাইসেন্স নবায়ন করার সময় জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদান বিভাগ আবশ্যিকভাবে বিদ্যমান থাকতে হবে— এমন শর্ত যুক্ত করতে কেন নির্দেশনা দেওয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চান আদালত।
স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
রিট দায়েরের পটভূমি সম্পর্কে ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশে বিদ্যমান হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ কর্তৃক যেকোনো অসুস্থ ব্যক্তি, যাদের যথাসময়ে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া না হলে মৃত্যু, স্থায়ী নানাবিধ শারীরিক জটিলতার শিকার হতে পারেন— এমন ব্যক্তিদের জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে বিবাদীগণের ব্যর্থতায় আবেদনকারীগণ সংক্ষুব্ধ হয়েছেন। সামান্য অজুহাতে অসুস্থ ব্যক্তিদের জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যমান সব হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহের একটি স্বাভাবিক চিত্র।
রিট আবেদনে জরুরি সেবা প্রয়োজন কিন্তু সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল বা ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের সেবা না দেওয়ার বিভিন্ন তথ্য/প্রতিবেদন যুক্ত করা হয়।
এসব ঘটনা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
গত ৯ জানুয়ারি জামালপুরের মাদারগঞ্জের আল্পনা নামের এক প্রসূতি নারীর তীব্র প্রসব বেদনা শুরু হলে তিনি নিকটস্থ মাদারগঞ্জ উপজেলা হাসপাতালে যান। কিন্তু কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রসূতি নারীর শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর তাকে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে অস্বীকৃতি জানান। তাকে জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেন। কিন্তু জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে প্রসূতি ওই নারীর তীব্র প্রসব বেদনা শুরু হয় এবং তিনি নিকটস্থ বকুলতলা মৈত্রী ক্লাবে সন্তান প্রসব করেন।
শুধু ওই ঘটনা নয়, ২০১৬ সালে মেডিকোলিগ্যাল প্রকৃতি/পরবর্তীতে আইনি জটিলতা তৈরি হতে পারে— এমন অজুহাতে সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত এক ব্যক্তিকে পরপর তিনটি পৃথক বেসরকারি হাসপাতাল থেকে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে অস্বীকৃতি জানানো হয়। পরবর্তীতে চতুর্থ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি মারা যান। এছাড়া, ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে আর্থিক সঙ্গতি/সামর্থ্য না থাকায় অবসটেট্রিক ইস্যুতে জরুরি অবস্থায় থাকা এক প্রসূতি নারীকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়নি।
পরবর্তীতে আজিমপুরের মাতৃসদন ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের গাড়ি পার্কিংস্থলে ওই প্রসূতি নারী অপর দুই নারীর সহায়তায় মৃত সন্তান প্রসব করেন।
২০১৮ সালে মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত ও জীবন সংশয়ে থাকা কোটা সংস্কারের আন্দোলনকারী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তরিকুল ইসলামকে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদান না করেই জোরপূর্বক রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়া হয়।
এছাড়া ২০১৮ সালে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাবকালীন চিকিৎসাসেবা না পাওয়ার প্রচুর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
এসব প্রতিবেদন সংযুক্ত করে বাংলাদেশে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদান সংক্রান্ত একটি নির্ভরযোগ্য ও সর্বজনস্বীকৃত আইনি অবকাঠামো উন্নয়নে বিচার বিভাগীয় হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করে রিট দায়ের করে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও একাডেমি অব ল অ্যান্ড পলিসি (আলাপ)।
এমএইচডি/এমজে