রাজধানীর পল্লবী থানায় পুলিশ হেফাজতে ইশতিয়াক হোসেন (জনি) নামে এক যুবকের মৃত্যুর দায়ে বরখাস্তকৃত যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এসআই জাহিদুর রহমান জাহিদ, এএসআই রাশেদুল হাসানকে প্রদত্ত রায়ের জরিমানার ১ লাখ টাকা করে এবং সাত বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত পুলিশের সোর্স রাসেল, সুমনকে জরিমানার ২০ হাজার টাকা করে আগামী এক মাসের মধ্যে পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি আসামিদের রিভিশন আবেদন শুনানি করার জন্য আগামী দুই মাসের মধ্যে এই মামলার পেপারবুক তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

গতকাল বুধবার বিচারপতি এসএম কুদ্দুস জামান ও বিচারপতি শাহেদ নুরউদ্দিনের  হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

আদালতে আসামি পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক। অপরদিকে ছিলেন আইনজীবী এসএম রেজাউল করিম, বদিউজ্জামান তপাদার এবং মোহাম্মদ নাজমুল করিম।

বৃহস্পতিবার (১১ মে) আদেশের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আইনজীবী এসএম রেজাউল করিম।

তিনি বলেন, পল্লবী থানায় পুলিশ হেফাজতে ইশতিয়াক হোসেন (জনি) মৃত্যুর দায়ে দণ্ডিত আসামিরা রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন করেন। আদালত রিভিশন আবেদন শুনানির জন্য গ্রহণ করে। এরপর আসামিরা হাইকোর্টের পৃথক পৃথক বেঞ্চে জামিন আবেদন করে। তখন রিভিশন শুনানি ও জামিন আবেদন একই বেঞ্চে শুনানি করার জন্য আমরা (বাদী পক্ষ) প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করি। প্রধান বিচারপতি আমাদের আবেদন গ্রহণ করে বিচারপতি কুদ্দুস জামানের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে আসামিদের রিভিশন আবেদন ও জামিন আবেদন শুনানির জন্য নির্ধারণ করে দেন। বুধবার এই কোর্টে আসামিপক্ষ জামিন আবেদনের ওপর শুনানি করতে চাইলে আমরা আদালতকে বলেছি, আসামিদের আপিল ও জামিন আবেদন যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে করা হয়নি‌।

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর ১৫ এর (৪) উপ-ধারায় বলা হয়েছে, ‌‘এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধের জন্য সাজাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তিকে দণ্ড ঘোষণার দিন থেকে ১৪ (চৌদ্দ) দিনের মধ্যে উপ-ধারা (১), (২) ও (৩) এ বর্ণিত অর্থ বিচারিক আদালতে জমা দিতে হইবে। এইরূপ আবশ্যিকতা পূরণ ব্যতীত এই আইনের আওতায় কোনো অপরাধের দণ্ডের বিরুদ্ধে কোনো আপিল করা যাইবে না।’

আর ১৫ এর (১) উপ-ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি এই আইনের ধারা ১৩ এর উপ-ধারা (১) এর অধীনে দোষী সাব্যস্ত হইলে তিনি অন্যূন পাঁচ বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অন্যূন পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং উহার অতিরিক্ত পঁচিশ হাজার টাকা ক্ষতিগ্রস্ত/সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি/ব্যক্তিদেরকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করিবেন।’

এবং ১৫ এর (২) উপ-ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে যদি নির্যাতন করেন এবং উক্ত নির্যাতনের ফলে উক্ত ব্যক্তি যদি মৃত্যুবরণ করেন তাহা হইলে নির্যাতনকারী এই আইনের ধারা ১৩ এর উপ-ধারা (১) অনুযায়ী অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে এবং তজ্জন্য তিনি অন্যূন যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং উহার অতিরিক্ত দুই লক্ষ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত/সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি/ব্যক্তিদেরকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করিবেন।’

এ ছাড়া ১৫ এর (৩) উপ-ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি এই আইনের ধারা ১৩ এর উপ-ধারা (২) এর অধীনে দোষী সাব্যস্ত হইলে তিনি অন্যূন দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অন্যূন বিশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’

আইনজীবী রেজাউল করিম আরও বলেন, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতও রায়ে এই বিষয়টি বলে দিয়েছেন। কিন্তু এসআই জাহিদ ও এএসআই রাশেদুল রায় অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের ২ লাখ টাকা করে প্রদান করলেও জরিমানার ১ লাখ টাকা করে পরিশোধ করেনি। তাই আমরা আদালতকে বলেছি জরিমানার টাকা পরিশোধ না করে জামিন আবেদনের ওপর শুনানি চলতে পারে না।

তখন আদালত উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত এসআই জাহিদুর রহমান জাহিদ, এএসআই রাশেদুল হাসান এবং পুলিশের সোর্স রাসেল ও সুমনকে আগামী এক মাসের মধ্যে জরিমানার টাকা আদালতে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি ২ মাসের মধ্যে এএসআই রাশেদুল হাসানকে এই মামলার পেপারবুক তৈরি করতে বলেছেন আদালত।

রাজধানীর পল্লবী থানায় পুলিশ হেফাজতে ইশতিয়াক হোসেন (জনি) মৃত্যুর দায়ে ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তিন পুলিশ সদস্যকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ১ লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। এ ছাড়া তিন পুলিশ সদস্যের প্রত্যেককে ২ লাখ টাকা করে বাদী বা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। অপর দুই আসামি পুলিশের সোর্স (তথ্যদাতা) সুমন ও রাসেলের সাত বছর কারাদণ্ড এবং ২০ হাজার টাকা করে জরিমানার আদেশ দেওয়া হয়। 

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশের আদালত এই রায় দেন। দণ্ডিত আসামিদের দুজন এখনো পলাতক। তারা হলেন এএসআই কামরুজ্জামান ও পুলিশের সোর্স রাসেল।

২০১৩ সালে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন প্রণীত হওয়ার পর এ বিষয়ে এটিই প্রথম রায়।

এমএইচডি/এমএ