চট্টগ্রামের ছেলে আরাফাত মোস্তফা। বাবার চাকরির সুবাদে জন্ম সৌদি আরবের মদিনা শহরে। সেখানেই কেটেছে ছোটবেলা। তবে শিক্ষা জীবনের শুরুটা বাংলাদেশে। এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেছেন চট্টগ্রাম থেকে। এরপর ব্যারিস্টারি পড়তে পাড়ি জমান লন্ডনে। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে এলএলবি সম্পন্ন করে ২০১৯ সালে নট্রিংহাম ট্রেন্ট ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যারিস্টারি ডিগ্রী লাভ করেন আরাফাত। ব্যারিস্টারি পাস করে ইংল্যান্ড ভিত্তিক দুবাইয়ের একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে লিগ্যাল অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। 

পার্লামেন্টের আইন প্রণয়নে কাজ করতে চাওয়া ব্যারিস্টার আরাফাত মোস্তফা সম্প্রতি যুক্তরাজ্য সরকারের বিচার মন্ত্রণালয়ের আইন উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। স্বপ্ন পূরণের পথে একধাপ এগিয়ে গেছেন তিনি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জনসাধারণের মাঝে  আইন সচতেনতা নিয়ে কাজ করতে চান যুক্তরাজ্য সরকারের এ আইন উপদেষ্টা। এ পদে নিয়োগ পাওয়ার গল্প, ভবিষ্যত পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপ হয়েছে আরাফাত মোস্তফার। অনলাইন মাধ্যমে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেদী হাসান ডালিম।

ঢাকা পোস্ট : আপনার পরিবার, ছোটবেলার দিনগুলো, শিক্ষাজীবন নিয়ে জানতে চাই।

ব্যারিস্টার আরাফাত মোস্তফা : আমার জন্ম সৌদি আরবের মদিনা শহরে। বেড়ে ওঠা সেখানেই। চট্টগ্রাম বোয়ালখালি থানার কধুরখিল গ্রামে আমার পৈত্রিক বাড়ি। মা হাসিনা আক্তার কাদেরী মোহরা মাওলানা নুরুল হুদা কাদেরীর কন্যা। আমার বাবা ডা. গোলাম মোস্তফা  সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ৩৬ বছর ডাক্তার হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। দাদা জালাল উদ্দিন আহমেদ দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ এয়ারফোর্সে ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি পাকিস্তান ও স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ এয়ারফোর্সে যোগ দেন। 

চট্টগ্রাম থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করেছি। তারপর ইংল্যান্ডে চলে যাই। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে গ্রাজুয়েট সম্পন্ন করে বার এট ল করেছি নট্রিংহাম ট্রেন্ট ইউনিভার্সিটি থেকে। পাহাড় বেয়ে ঝরের রাতে লাইব্রেরিতে অগণিত রাত কাটানো, হরিণের সঙ্গে খেলতে খেলতে সুর্যাস্ত দেখা দিনগুলো ছিল পরিশ্রমের কিন্তু রঙ্গিন আনন্দময়ও। আমার পরিবার অনেক ত্যাগ করেছে। বাবা ডা. গোলাম মোস্তোফা ৩৬ বছর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সেবা প্রদান করে কোভিডে ২০২০ সালে মদিনাতে ইন্তেকাল করলে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার মুখে আমরা সেখানে যেতে পারিনি। সৌদি সরকার সসম্মানে তাকে জান্নাতুল বাকিতে দাফনের ব্যবস্থা করেন। তার জন্যই আজ আমাদের এটুকু পথ চলা। সবাই বাবার জন্য দোয়া করবেন।  

ঢাকা পোস্ট : যুক্তরাজ্যের বিচার মন্ত্রণালয়ের আইন উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, এ বিষয়ে জানতে চাই।

ব্যারিস্টার আরাফাত মোস্তফা : আইন উপদেষ্টা হতে পাঁচ বছরের কাজের অভিজ্ঞতাসহ ব্যারিস্টার, সাইলেক্স অথবা সলিসিটর হতে হয়। আমি সেপ্টেম্বর মাস থেকে যুক্তরাজ্য সরকারের বিচার মন্ত্রণালয়ের আইন উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছি। 

আইন উপদেষ্টার কাজ নির্ভর করে ডিপার্টমেন্টের ওপর। আন্তর্জাতিক পলিসি রিভিউ, আইন প্রণয়নের খসড়া রিভিউ কারেকশন, হিউম্যান রাইটস পলিসি, আদালতে সরকারের প্রতিনিধিত্ব করা বা পার্লামেন্টে আইন প্রনয়নে সহযোগিতাসহ বিভিন্ন ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হয়।

ঢাকা পোস্ট : আইন উপদেষ্টা হিসেবে আপনার কী কী কাজ করতে হবে?

ব্যারিস্টার আরাফাত মোস্তফা : আমার দায়িত্ব ম্যাজিসট্রেটদের আইনগত ও বিচারগত দিক থেকে কার্যক্রম ভুল হচ্ছে কিনা তা মনিটরিং করা। সুষ্ঠুভাবে বিচারকার্য পরিচালনা নিশ্চিত করা, তাদের আইনি সূক্ষ্ম বিষয়ে জানানো। পাশাপাশি জেলা জাজদের উপদেশ এবং বিচারিক সকল প্রক্রিয়াতে সহযোগিতা করার দায়িত্ব। একজন উপদেষ্টা জাজ এবং ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়াও বাদী বিবাদী উভয়ের স্বার্থ বজায় রাখেন। এছাড়া কোর্টে যাদের প্রতিনিধি বা আইনজীবীর সেবা নেওয়ার আর্থিক ক্ষমতা নেই তাদের দিক নির্দেশনাও প্রদান করেন।

ঢাকা পোস্ট : যুক্তরাজ্যে একজন আইন উপদেষ্টা কী কী সুযোগ-সুবিধা পান?

ব্যারিস্টার আরাফাত মোস্তফা : পিতৃত্ব বা মাতৃত্বকালীন ছুটি, ইতিবাচক কাজের সূচি, পেনশন সুবিধা। এছাড়া আমি যেটা বলবো—একজন উপদেষ্টা স্বল্প সময়ে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে তা অন্যভাবে হয়তো অনেক সময়ের প্রয়োজন হতো। ৩-৫ বছর পর উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে উপদেষ্টাদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। এ জন্য মন্ত্রণালয় থেকে সুপারিশও করা হয়। এছাড়াও কেউ চাইলে মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দায়িত্বে বদলি নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

ঢাকা পোস্ট : বাংলাদেশি ব্যারিস্টার আগে যুক্তরাজ্য সরকারের আইন উপদেষ্টা হয়েছেন কী?

ব্যারিস্টার আরাফাত মোস্তফা : এ তথ্য আমার জানা নেই। আমার পরিচিতদের মধ্যে কেউ নেই। তবে বর্তমানে অনেকে এন্ট্রি লেভেল পদগুলোতে যেমন;  প্রবেশন ওয়ার্কার, কেইস ওয়ার্কার বা পেশকার পদে নিয়োজিত হয়েছেন। এছাড়া যুক্তরাজ্য পার্লামেন্টে একজন বাংলাদেশি আইনজীবী কর্মরত আছেন। বাংলাদেশিরা আরো এগিয়ে আসুক, আগামীতে বিভিন্ন উচ্চপদে বাংলাদেশিরা আসুক এটাই প্রত্যাশা। এ জন্য দিকনির্দেশনা দিয়ে আমি সহায়তা করতে প্রস্তুত।

ঢাকা পোস্ট : আইন শিক্ষার্থীদের জন্য কী পরামর্শ দেবেন?

ব্যারিস্টার আরাফাত মোস্তফা : শিক্ষার্থীদের এতটুকুই বলবো কেউ দ্রুত অর্থ লাভের প্রচেষ্টায় যেন এই পেশা বেছে না নেন। এখানে অনেক ত্যাগ আর অধ্যবসায় প্রয়োজন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সততা। সততা ও নিষ্ঠা থাকলে—সামাজিক ও আর্থিক দিক থেকে সফলতা আসবেই। 

শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রচলিত আছে; আইন না জানলেও তুমি কাকে চেনো এটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি বলবো এ ধরনের কথা বিশ্বাস না করতে। ড. কামাল হোসেন স্যার, বিচারপতি ইমান আলী কিংবা বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ স্যার কাউকে চিনে কেউ আইনের মহিরুহ হয়ে উঠেননি। জ্ঞান অন্বেষণের প্রয়োজন সর্বাধিক। 

ঢাকা পোস্ট : আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা? 

ব্যারিস্টার আরাফাত মোস্তফা : আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা পার্লামেন্ট এ  আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করা। যেন সবাই আইনি বিচার পেতে পারেন। এমনকি ইউকেতেও নীতিমালায় সংস্কার খুবই প্রয়োজন।

বাংলাদেশের সামগ্রিক আইন ব্যবস্থা নিয়ে সবাই হতাশ। তবে আমার সমসামিয়ক ও তুলনামূলকভাবে সিনিয়র এবং কিছু জুনিয়র আইনজীবী নিয়ে আমি দারুণ আশাবাদী। পরিবর্তন আসবেই। আইনেরর দুয়ার শুধু কাগজে নয় বাস্তবতায়ও সবার কাছে পৌঁছে যাবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। আমি ভবিষ্যতে দেশে আইন সচতেনতা নিয়ে জনসাধারণের মাঝে কাজ করতে চাই। যেন কোর্টে আসতে কেউ দ্বিধা না করেন। সবাই নিজের অধিকার নিয়ে সচেতন হন। আর এই সচেতনতা এলে তবে আইন তার প্রকৃত গতিপথ মেনে চলতে বাধ্য।

এমএইচডি/এমএসএ