আমিনুল ইসলাম আমিন/ ছবি : ঢাকা পোস্ট

আওয়ামী লীগের ২২তম সম্মেলনের মাধ্যমে পদোন্নতি পেয়েছেন আমিনুল ইসলাম আমিন। তিনি গত কমিটির উপ-প্রচার সম্পাদক ছিলেন। বর্তমান কমিটিতে ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক পদ পেয়েছেন। দলের সক্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ নেতা তিনি। তৃণমূল থেকে উঠে আসা আপাদমস্তক এ রাজনীতিবিদ আওয়ামী লীগের ভালো সময় যেমন দেখেছেন তেমনি খারাপ সময়ের সাক্ষীও তিনি। অতীতের দুঃসময়ের স্মৃতি ও নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিজের প্রস্তুতি নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে।

ঢাকা পোস্ট : নতুন দায়িত্ব কেমন চ্যালেঞ্জিং মনে করছেন?

আমিনুল ইসলাম আমিন : নতুন দায়িত্ব অবশ্যই আনন্দের এবং চ্যালেঞ্জের। কারণ আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে সমাজের জন্য কাজ করার অনেকগুলো জায়গা যেমন আছে, তেমনি নানা দুর্যোগ দুর্বিপাকে মানুষের পাশে দাঁড়ানো দায়িত্ববোধও আমাদের আছে। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ক্ষমতায় থাকুক বা না থাকুক সব সময় মানুষের পাশে ছিল, এখনও আছে। এমনকি ১/১১ সময় বঙ্গবন্ধুর কন্যা কারাগারে থেকে আমাদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তার জন্য চিন্তা না করে সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। আমি চেষ্টা করব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা নিয়ে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের পরামর্শে ‘রাউন্ড দ্যা ইয়ার’ সমাজ কল্যাণমূলক কাজ করার। বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর পাশে থেকে তাদের জন্য কাজ করার চেষ্টা করব।

ঢাকা পোস্ট : ছাত্রলীগ থেকে আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক, এই দীর্ঘ সময়ে আপনার রাজনৈতিক পথ চলাটা কেমন ছিল?

আমিনুল ইসলাম আমিন : আমার বাবা আওয়ামী লীগ করতেন। মুক্তিযুদ্ধেও বাবার অনেক ভূমিকা ছিল। আমি আমার গ্রামে খুব একটা ছিলাম না। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবা  আমাদের গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সময়ে আমাদের বাড়ির প্রবেশ পথে খোদাই করে ‘জয় বাংলা’ লেখা ছিল। আমি সেই পরিবারের সন্তান। কিশোর বয়স থেকে বাবার হাত ধরে রাজনীতিতে আসা। আমি যখন যে কাজটা করেছি, সেটাকে মন-প্রাণ উজাড় করে করার চেষ্টা করেছি। আজকের দিনে যেমন একটি দলীয় পদ পাওয়ার জন্য নানা তদবির, এগুলো আমাদের সময় ছিল না। আমি কোনো দিন বলিনি আমাকে একটা পদ দেন।

আমার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে আমার সিনিয়র নেতারা কাজ করার নানা ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছেন। আমি এটাকে সবসময় উপভোগ করেছি। তবে, যেহেতু আমি চট্টগ্রামে রাজনীতি করেছি, সেখানে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির একটা শক্ত অবস্থান ছিল। ১৯৮৩-৮৪ সালে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি করতে গিয়ে আমাকে নানা ধরনের প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছিল। ১৯৮৪ সালের ২৫ অক্টোবর লালদিঘি মাঠ এবং ১৯৮৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মহসিন কলেজে দুই দু’বার আমার উপর প্রাণঘাতী হামলা হয়েছে। আমার সিনিয়র নেতারা আমাদের গাইড করেছেন, যা আমার চলার পথে সাহস যুগিয়েছে। পাশাপাশি নানা প্রতিবন্ধক সমাধান করতে সহযোগিতা করেছেন। সব মিলে ছাত্রজীবন থেকে এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক পথ চলাটা অবশ্যই আমার অনেক বড় প্রাপ্তি ছিল, একই সাথে চ্যালেঞ্জিংও। 

ঢাকা পোস্ট : চট্টগ্রামের সিনিয়র নেতারা কেমন সহযোগিতা করতেন?

আমিনুল ইসলাম আমিন : আমি সিনিয়র নেতাদের পরামর্শে মাদ্রাসায় ছাত্রলীগের কমিটি করেছিলাম। কমিটি করার ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও সাবেক মেয়র আজম নাছিরসহ অনেকে আমাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন। আমি মাদ্রাসায় কমিটি করব সেটা শুনে মহিউদ্দিন ভাই আমি যে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছিলাম সেখানে হাজির হয়েছিলেন। আমি যখন মধ্যরাতে দেয়ালে লিখতাম, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার চাই, সেই সময়ে নেতা নাছির ভাই, ইউনুস ভাই কিন্তু রাতে থাকতেন আমার সঙ্গে। একদিন রাতে মহিউদ্দিন ভাই গিয়ে হাজির, আমি তো বিশ্বাসই করতে পারিনি। সে সময় কর্মীদের প্রতি নেতাদের এ রকম একটা দরদ ছিল। এটা কিন্তু আমাদের দুঃসময়ে অথবা অন্ধকার সময়ে আলো পথ দেখাত।
  
ঢাকা পোস্ট : সেই সময়ের রাজনীতি আর বর্তমান রাজনীতির মধ্যে কী পরিবর্তন লক্ষ্য করেন আপনি? 

আমিনুল ইসলাম আমিন : পরিবর্তন অবশ্যই হয়েছে। পরিবর্তন হওয়াটা দোষের কিছু নয়। এটা সময়ের দাবি। কাজের ধরনের পরিবর্তন হওয়াটাকে আমি সমর্থন করি। কিন্তু পরিবর্তনের নামে, আধুনিকতার নামে নীতি নৈতিকতার অবক্ষয়কে আমি সমর্থন করতে পারি না। আমরা কোনো সময় নেতাদের গিয়ে বলিনি যে, আমাদের নেতা বানান। আমাকে একটা পদ দেন। যারা কাজ করেছে তাদের মূল্যায়ন করতে চেষ্টা করেছে তারা। এখন কিন্তু সেই জায়গাটা নেই। কোনো দিন রাজনীতি না করে এখন পদ পেয়ে যাচ্ছে, এটা শুধু ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগে না, রাজনৈতিক কালচার এমন হয়ে গেছে। এছাড়া বিভিন্ন ভাবে নেতাদের প্রভাবিত করা হচ্ছে। বিভিন্ন পদ ভাগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, কেউ একজন নেতা হলেই তার পেছনে প্রটোকল বলেন বা মানুষের মহড়া। এগুলো আমার দৃষ্টিতে রাজনীতির ইতিবাচক কোনো দিক নয়। এগুলো মানুষ ভালোভাবে দেখে না।

আমাদের সময়ে কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচন রেগুলার ছিল। প্রত্যেকটা ছাত্র সংগঠন কলেজ সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করার জন্য কলেজ সংসদ নির্বাচনে ভিপি, জিএসসহ প্যানেল মনোনয়নের ক্ষেত্রে এমন ছাত্রনেতাদের মনোনয়ন দিত যারা দলের বাইরেও সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে পপুলার ছিল, পরিচ্ছন্ন ইমেজের অধিকারী ছিল। সে কারণে দেখা গিয়েছে মেধাবী এবং পরিচ্ছন্ন ইমেজের ছাত্রনেতারা ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতো। এখন বলতে গেলে কলেজ সংসদ নির্বাচন হয় না। বর্তমান সময়ে এটা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এখন আমার ধারণা হচ্ছে, রাজনীতির প্রতি সবাই আগ্রহী হচ্ছে যতটুকু না কমিটমেন্ট, আদর্শবোধ ধারণ করছে, তার চেয়ে বেশি ব্যক্তিগত প্রাপ্তির হিসাব মেলানোর জন্য। যেটা রাজনীতির জন্য শুভ দিক নয়। দেশ সেবার মানসিকতা নিয়ে তরুণ সমাজকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে হবে। এতে মানুষ উপকৃত হবে।

ঢাকা পোস্ট : আদর্শিক পরিবর্তন ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে কেমন প্রভাব পড়বে?

আমিনুল ইসলাম আমিন : রাজনীতি হচ্ছে মানুষের জন্য কিছু করার বড় প্ল্যাটফর্ম। এটা ব্রত, এটা কখনো ইনকাম সোর্স হতে পারে না। আমরা আওয়ামী লীগ করি, আমাদের আদর্শ বঙ্গবন্ধু, তার আদর্শকে ফলো করি। বর্তমানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। আমরা যদি দুই জনকে মিলিয়ে দেখি তাহলে দেখব তারা মানুষের সেবা করার জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়ে রাজনীতি করেছেন। তারা ব্যক্তিগত প্রাপ্তির হিসাব মেলাননি। তাদের কাছে ব্যক্তিগত প্রাপ্তি ছিল শুধু মানুষের ভালোবাসা। যেমন, জাতির পিতা বলেছিলেন, আমি সব হারাতে পারি বাঙালির ভালোবাসা হারাতে পারি না। পাকিস্তানি কারাগারে তার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল, তখন বলা হলো তোমার শেষ ইচ্ছা কী? তিনি বলেছিলেন, ‘তোমাদের কাছে কোনো চাওয়া নেই। লাশটা শুধু বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিও।’

রাজনীতিতে যারা নতুন আসছে তাদের স্বাগত জানাই। তাদেরও মটো হতে হবে ‘সার্ভ দ্যা ন্যাশন’। এটা নিয়ে তারা যখন রাজনীতিতে আসবে তখন আওয়ামী লীগ বা অন্য কোন দল ক্ষমতায় আসলে সে দলের নেতাদের মধ্যে আমি কী পেলাম, আমার সম্পদ কতটুকু বাড়ল, আমার ক্ষমতা কতটুকু বাড়ল, দাপট কতটুকু বাড়ল সেটা কাজ করবে না। যখন সেটি কাজ করবে না তখনই কিন্তু দেশ, জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে। দেশ সামনে এগিয়ে যাবে।

ঢাকা পোস্ট: নতুন দায়িত্ব নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?

আমিনুল ইসলাম আমিন : আমি মাত্র দায়িত্ব পেলাম। আমার একটি সাব কমিটির বিষয় রয়েছে। এর আগেও যিনি এই দায়িত্বে ছিলেন তিনি অনেকগুলো ভালো কাজ করেছেন। বিশেষ করে করোনা মহামারির সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি কাজ করেছেন। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পরামর্শ অনুযায়ী এটাকে আমরা রাউন্ড দ্যা ইয়ার, শুধু দুর্যোগ কেন্দ্রিক বা সিজনাল না করে, সারা বছর যেন আমরা সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য সিস্টেমেটিক ওয়েতে কাজ করতে পারি সেই রকম একটি চিন্তা আছে। কাজটা কোন পদ্ধতিতে হবে সেটা হয়ত কমিটি গঠনের পর বসে আলোচনা করা হবে।

ঢাকা পোস্ট : বিরোধী দলগুলো আগামী নির্বাচনে আসবে কীনা এখনও নিশ্চয়তা দেয়নি, নির্বাচনে না আসলে আওয়ামী লীগের অবস্থান কী হবে?

আমিনুল ইসলাম আমিন : বিরোধী দল নির্বাচনে আসবে কী আসবে না সেটা তাদের ব্যাপার। এটা নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা থাকার কোনো কথা নয়। গণতন্ত্রিক ধারার রাজনীতিতে সরকার পরিবর্তনের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে ভোট। আবার ক্ষমতায় যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম ভোট। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতি যারা করে এটা তাদের দায়িত্ব, তারা জনগণের রায় নিয়ে ক্ষমতা যেতে চাইবেন নাকি চাইবেন না। যদি তারা আসতে না চায়, সংবিধানের এমন কোথাও লেখা নেই যে সরকারি দল তাদের হাতে পায়ে ধরে নির্বাচনে আনতে হবে।

আজকে বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে নিয়ে অনেক কথা বলে। সবগুলো বাস্তবতা বিবর্জিত। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত যতবার ক্ষমতায় এসেছে জনগণের ভোটে এসেছে। আওয়ামী লীগ আইয়ুব খান, জিয়া খান কিংবা এরশাদের মতো বন্দুকের নল ঠেকিয়ে ক্ষমতা আসেনি। নির্বাচনে মানুষের রায় পাওয়ার জন্য মানুষের কাছে যেতে হবে। সেজন্য আমরা ৫ বছরই ভোটের কাজ করি। আমরা নির্বাচনের আগে কমিটমেন্ট করি, আমরা কী কাজ করব।

ঢাকা পোস্ট : নির্বাচনে দেওয়া আওয়ামী লীগের কমিটমেন্ট কতটুকু বাস্তবায়ন করেছে বলে আপনি মনে করেন?

আমিনুল ইসলাম আমিন : আমরা পাকিস্তান আমলে বলেছিলাম নৌকায় ভোট দেন, আমরা স্বাধিকার দেব। মানুষ আমাদের ভোট দিয়েছিল আমরা স্বাধিকার আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের রূপান্তর করে স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছিলাম। ৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। ২১ বছর আওয়ামী লীগ এদেশে নিষিদ্ধ নাম ছিল। ৯৬ এ আমরা ক্ষমতায় আসলাম। আমরা কমিটমেন্ট করেছিলাম, আমাদের ভোট দিলে বেটার জীবন দেব। সে পাঁচ বছরে দ্রব্যমূল্য ছিল স্থিতিশীল। মাত্র ১০ টাকায় ছিল চাল, ২৬ টাকায় চিনিসহ অন্যান্য দ্রব্যগুলো পাওয়া যেত।

২০০১ সালের ষড়যন্ত্রের কারণে আমরা পরাজিত হলেও ৯৬ নির্বাচনের তুলনায় ৪ শতাংশ ভোট বেশি পেয়েছিলাম। ৯৬ নির্বাচনে ৩৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ক্ষমতায় আসলেও ২০০১ সালে ৪১ শতাংশ ভোট পেয়েছি। ক্ষমতায় থেকে ৪ শতাংশ ভোট বাড়ানো কঠিন একটি কাজ। ২০০৮ সালে কমিটমেন্ট করেছিলাম আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করব। অনেকেই টিপ্পনী কেটে ছিল, আজকে ২০২৩ এসে আমাদের প্রতিটি স্টেপে উপলব্ধি করতে পারছি যে, আমাদের স্লোগানটা শুধু স্লোগানে সীমাবদ্ধ নয়, সেটা আমরা বাস্তবে রূপান্তরিত করেছি। যে কারণে আজকের জীবনটা অনেক ক্ষেত্রে সহজ হয়ে গেছে। 

এমএসআই/এসকেডি