চার বছর আগে রাজধানীর পল্লবীতে নিজ সন্তানের সামনে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন শাহিন উদ্দিন। এ ঘটনায় করা মামলায় তদন্ত শেষে তৃতীয় দফায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। এতে লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক এমপি ও ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান এমএ আউয়ালসহ ১৬ আসামিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। 

এর আগে প্রথম দফায় তদন্ত সংস্থা ডিবি ১৫ জন আসামি এবং দ্বিতীয় দফায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ১৬ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছিল। তবে এই দুই তদন্ত সংস্থার দেওয়া অভিযোগপত্রে দুজন আসামির নাম না থাকায় আপত্তি জানান ভুক্তভোগীর মা আকলিমা বেগম। 

এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক মো. শফিউল আজম খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ১৬ আসামিকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। সাক্ষীরা আদালতে অভিযোগ প্রমাণ করবেন। 

নিহতের মা আকলিমা বেগম বলেন, অভিযোগপত্র দেওয়া হলেও আমাকে জানানো হয়নি। আগের মতো করেই অভিযোগপত্র দিয়েছে। এ বিষয়ে নারাজি দেব কি না এখনো সিদ্ধান্ত নেইনি। তবে আসামিদের বিচার হওয়া উচিত। আমরা ন্যায়বিচার চাই। 

অভিযোগপত্রে উল্লিখিত অন্য আসামিরা হলেন- মোহাম্মদ তাহের, মো. সুমন ব্যাপারী, মো. মুরাদ, মো. টিটু শেখ, গোলাম কিবরিয়া খান, বাওনা সুমন ওরফে ইব্রাহিম সুমন ওরফে তোফাজ্জল হোসেন, রকি তালুকদার, মো. শরিফ, মো. তুহিন মিয়া, মো. তরিকুল ইসলাম ইমন, হারুনুর রশিদ, নুর মোহাম্মদ হাসান মোতাইত, ইকবাল হোসেন নুর, মো. শফিকুল ইসলাম শফিক ও প্রতিক আহম্মেদ সজিব।

এছাড়া মো. দিপু, কালু ওরফে কালা বাবু, জহিরুল ইসলাম, মঞ্জুরুল হাসান বাবু ওরফে ব্লেড বাবু ওরফে ইয়াবা বাবু, মো. শফিক, আব্দুর রাজ্জাক, কামরুল, মরন আলী, মো. লিটন, আবুলের বিষয়ে এ মামলায় কোনো তথ্য প্রমাণ না পাওয়ায় এবং ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আসামি মানিক ও মনির নিহত হওয়ায় তাদেরকে এ মামলার দায় থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে।

মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, পল্লবী থানা এলাকায় আলিনগর আবাসিক প্রকল্পে নিহত শাহিনসহ ১৩ জন জড়িত ছিল। আউয়ালের মালিকানাধীন হ্যাভেলি প্রোপার্টি লিমিটেডের পক্ষে আসামি সুমন ব্যাপারী ও নিহত শাহিন প্রকল্পের সব উন্নয়নমূলক কাজ করতেন। তবে কাজ করা নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে ২০২০ সালের ২৪ নভেম্বর শাহিনের ওপর হামলা করে আসামি সুমন ব্যাপারী ও টিটু। চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে শাহিন আবাসিক প্রকল্পের কাজ শুরু করেন। ওই বছরের ডিসেম্বরে নিহত শাহিন উদ্দিন ও মাইন উদ্দিন মিলে মোস্তফা কামালের জায়গায় বাউন্ডারি দেয়ালের কাজ করে। পরে আসামি সুমনের নেতৃত্বে অন্য আসামিরা মিলে এই বাউন্ডারি দেয়াল ভেঙে দেয়। পরে সুমনের সঙ্গে শাহিনের ওই এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আবার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তখন হ্যাভেলি প্রোপার্টি লিমিটেডের সঙ্গে শাহিনের দূরত্ব তৈরি হয়। পরে সুমনকে কোম্পানির পক্ষে কাজ দেওয়া হলেও তিনি প্রকল্পের ভেতরে কাজ করতে পারেন না। কোম্পানি বাধ্য হয়ে শাহিনকে প্রকল্পে কাজ দেয়। এতে আসামি সুমন ক্ষুব্ধ হন। পরে শাহিন মোস্তফা কামালের ভেঙে দেওয়া বাউন্ডারি দেয়ালের কাজ করে। তখন ক্ষুব্ধ হয়ে আউয়াল ফোন করে আসামি সুমন ও টিটুকে ডেকে নিয়ে যান। শাহিন কীভাবে বাউন্ডারি দেয়ালের কাজ করল, তার কারণ জানতে চান তিনি। পরে আউয়াল তাদেরকে শাহিনের হাত, পা কেটে ফেলার কথা বলেন। এ সময় আসামি তাহের, কিবরিয়া ও সজীব উপস্থিত ছিলেন। 

অভিযোগপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, কয়েকদিন পর শাহিন প্রকল্পের পিলার ভেঙে দেন। এতে আসামি আউয়াল তার ওপর রাগান্বিত হন এবং মামলা করেন। এই মামলায় গ্রেপ্তারের পর শাহিন ও মাইন কারাভোগ করেন। জামিনে মুক্ত হয়ে তারা আলীনগর আবাসিক প্রকল্পের ১০ কাঠা বাউন্ডারি ভেঙে ফেলেন। আউয়াল পোলাপান খরচের জন্য আসামি সুমনকে ২০ হাজার টাকা দেন। পরে শাহিনকে মারার জন্য আসামি সুমন ও টিটু আলোচনা করে। এসময় ইটের টাকা দেওয়ার কথা বলে শাহিনকে ডাকার পরামর্শ দেন টিটু। পরে শাহিনকে মারার জন্য রকিকে লোক দিতে বলেন সুমন। তার কথা মতো রকি লোক দেয় এবং এ বাবদ তাকে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। আসামি সুমন ব্যাপারী আসামি শরীফকে একটি রাম দা, হারুনের হাতে একটি দা, তুহিনের হাতে ব্যাপারী ছুরি ও ইমনের হাতে একটি রাম দা দেন। তখন আসামি সুমন তাদের বলে তার কাছে একজন লোক আসবে, তাকে কোপাতে হবে। ২০২১ সালের ১৬ মে বিকেল ৪টায় শাহিনকে ইটের টাকা নিতে আসতে ফোন করেন আসামি সুমন। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে টাকা নিতে আসেন তিনি। এসময় সুমন শাহিনের কাঁধে হাত রেখে অন্যদের ইশারা করেন। তখন তারা এসে শাহিনকে তার ছেলের সামনে প্রকাশ্যে কোপাতে থাকেন। এতে তিনি মারা যান।

মামলা সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ১৬ মে শাহিন উদ্দিন হত্যাকাণ্ডের পর ওই রাতেই নিহতের মা আকলিমা বেগম বাদী হয়ে পল্লবী থানায় সাবেক এমপি আউয়ালসহ ২০ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০২১ সালের ১৬ মে বিকেল ৪টার দিকে সুমন ও টিটু নামের দুই যুবক শাহিন উদ্দিনকে জমির বিরোধ মেটানো হবে জানিয়ে ফোন করে ডেকে নেন। শাহিন উদ্দিন মোটরসাইকেলে পল্লবীর ডি-ব্লকের ৩১ নম্বর সড়কের ৪০ নম্বর বাসার সামনে গেলে সুমন ও টিটুসহ ১৪ থেকে ১৫ জন মিলে তাকে টেনেহিঁচড়ে ওই বাড়ির গ্যারেজে নিয়ে যায়। এ সময় শাহিন উদ্দিনের ছয় বছরের ছেলে মাশরাফি গেটের বাইরে ছিল। গ্যারেজে ঢুকিয়ে তাকে চাপাতি, চায়নিজ কুড়াল, রামদা দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। এরপর তাকে ওই গ্যারেজ থেকে বের করে ৩৬ নম্বর বাড়ির সামনে আবার কুপিয়ে ফেলে রেখে চলে যায়। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।

এ মামলার পর এমএ আউয়ালসহ ২১ আসামিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বর্তমানে সবাই জামিনে রয়েছেন। তদন্ত শেষে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এমএ আউয়ালসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক সৈয়দ ইফতেখার হোসেন। পরে একই বছরের ১২ মে আদালত শাহিন উদ্দিনের মায়ের নারাজি আবেদন গ্রহণ করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) মামলাটি পুনরায় তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। ২০২৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক মনির হোসেন ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন। তাতে আপত্তি জানিয়ে নারাজি আবেদন করা হয়। সেই নারাজির আবেদন গ্রহণ করে ওই বছরের ১৩ নভেম্বর সিআইডিকে মামলাটি তদন্তের আদেশ দেন আদালত।

এনআর/জেডএস