দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ভুল তদন্তে নোয়াখালীর নিরপরাধ কামরুল ইসলামের ১৫ বছরের সাজার রায় বাতিল করেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে তার বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এ সময় দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে  গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন।

আদালতে নিরপরাধ কামরুল ইসলামের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মিনহাজুল হক চৌধুরী। দুদকের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম খান।

এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ভুল তদন্তে নোয়াখালীর নিরপরাধ কামরুল ইসলাম ১৫ বছরের সাজা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হন। এদিকে, হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করে ভুলের কথা স্বীকার করে ক্ষমা চায় দুদক। 

ঘটনার বিবরণে জানা যায়, এসএসসির মার্কসিট ও সনদপত্রে জালিয়াতি করে নোয়াখালীর মাইজদী কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হন পশ্চিম রাজারামপুরের কামরুল ইসলাম। পরে জালিয়াতির ঘটনা নজরে আসায় কামরুল ইসলামের বিরুদ্ধে সনদ জালিয়াতির অভিযোগে ২০০৩ সালে মামলা করেন শহীদুল ইসলাম। মামলার এজাহারে আসামির ঠিকানা ‘পশ্চিম রাজারামপুর’ থেকে হয়ে যায় ‘পূর্ব রাজারামপুর’। এরপর তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরোর তদন্ত কর্মকর্তা (দুদকের উপ-পরিচালক) মাহফুজ ইকবাল এ মামলার তদন্ত করে ভুল আসামির বিরুদ্ধেই নোয়াখালীর বিচারিক আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন।

মামলা দায়েরের প্রায় ১০ বছর পর ২০১৩ সালে দুদক ওই চার্জশিট দাখিল করেন। পরে আসামিকে পলাতক দেখিয়ে নোয়াখালীর বিচারক আদালতে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। এ মামলার চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে ২০১৪ সালে রায় দেন আদালত। জালিয়াতির অপরাধে মোট তিনটি ধারায় ভুল আসামিকে (পূর্ব রাজারামপুরের মো. কামরুল ইসলাম) পাঁচ বছর করে মোট ১৫ বছরের কারাদণ্ড ও ৩০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেন আদালত।

এদিকে বিচারিক আদালতের রায়ের পর আসামিকে ধরতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন নোয়াখালীর আদালত। নামের মিল ও ঠিকানার ভুলে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পৌঁছায় পূর্ব রাজারামপুরে। এরপর দিশেহারা কামরুল দ্বারস্থ হন আইনজীবীর। আইনজীবীর পরামর্শে মামলা ও পরোয়ানা থেকে বাঁচতে রিট করেন।

কিন্তু পূর্ব রাজারামপুরের কামরুল ইসলাম এই মামলা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তার জন্ম ১৯৯০ সালে। আর সনদ জালিয়াতি হয়েছে ১৯৯৮ সালের। এ রায়ের পর পুলিশ তার বাড়িতে যায় গ্রেপ্তারের জন্য।

এ বিষয়ে নিরপরাধ কামরুলের আইনজীবী মিনহাজুল হক চৌধুরী বলেন, হাইকোর্টে নিরীহ কামরুলের পক্ষে যে রিট দায়ের করা হয় সেখানে- পূর্ব রাজারামপুরের কামরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার ও হয়রানি যাতে না করা হয় তার নির্দেশনা চেয়েছিলাম। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ৫ নভেম্বর হাইকোর্ট দুদকের তদন্ত কর্মকর্তার কাছে ঘটনার ব্যাখ্যা চান ও এ বিষয়ে রুল জারি করেন।

হাইকোর্টের নির্দেশনা পেয়ে টনক নড়ে দুদকের। ঘটনার তদন্ত শেষে হাইকোর্টে প্রতিবেদনও দাখিল করে দুদক। দুদক হাইকোর্টকে জানায়, মামলার এজাহার থেকে তদন্তের সব ক্ষেত্রেই ভুল হয়েছে। মামলার দীর্ঘ ১০ বছর পর চার্জশিট দাখিলের পূর্বে বারবার তদন্ত কর্মকর্তার বদল হয়েছে। এটা তাদের ‘সরল বিশ্বাসে’ ভুল ছিল। যেহেতু তারা ‘সরল বিশ্বাসে’ করেছে তাই দুদক আদালতের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে।

দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেন, ‘কামরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে এসএসসির সনদ জালিয়াতির অভিযোগে ২০০৩ সালে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো একটা মামলা করে। মামলায় ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে এসএসসির সনদ জালিয়াতি করে এইচএসসিতে ভর্তির অভিযোগ আনা হয়। সেই মামলায় আসামির ঠিকানা বদলে দেয়। মূল আসামি যিনি তার ঠিকানা হলো- নোয়াখালীর পশ্চিম রাজারামপুর। সে যে কলেজে ভর্তি হয়েছে সেখানে তার ছবি ছিল। ঠিকানা পশ্চিম রাজারামপুর লেখা ছিল। দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা এটাকে পূর্ব রাজারামপুর লিখে এফআইআর (প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন) করেন। এরপর ১০ বছর এ মামলার তদন্ত শেষ করে ২০১৩ সালে দুদক অভিযোগপত্র জমা দেয় পূর্ব রাজারামপুরের কামরুল ইসলামের নাম ঠিকানা দিয়ে। এরপর এ মামলা শুনানি নিয়ে ২০১৪ সালে বিচারিক আদালত তিনটি ধারায় পাঁচ বছর করে মোট ১৫ বছর সাজা দেন ও ৩০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেন। এক পর্যায়ে আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা আদালতকে বলেছি, এই কামরুল ইসলাম, সেই কামরুল ইসলাম না। সে তো জেলে ছিল না। তার অনুপস্থিতিতে বিচার হয়েছে। এখন সে হাইকোর্টে এসে বলেছে, সে ওই কামরুল ইসলাম না। আমরাও বলেছি সে ওই কামরুল ইসলাম না। সে জেলে টেলে যায়নি কখনও। আমরা আদালতের কাছে বলেছি, এটা ভুল হয়েছে।’

এমএইচডি/ওএফ