ছবি: বিশ্বরঙ

বাঙালি উৎসবপ্রিয় জাতি। তারা আনন্দ করতে ভালোবাসে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জীবনের জয়গান গায়। বাঙালির ‌‌‘বারো মাসে তের পার্বণ’ এর কথা সবার জানা। বছরজুড়ে নানাবিধ উৎসব লেগেই থাকে। পয়লা বৈশাখ এমন এক প্রাণের উৎসব, যা সমস্ত ধর্মের ও দেশের সর্বস্তরের মানুষের মিলিত হওয়ার।

পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। সম্রাট আকবর বাংলা নববর্ষের বর্ষপঞ্জি চালু করেছিলেন। তারপর থেকে কালের পরিক্রমায় নানা রঙে, নানা ঢং-য়ে পয়লা বৈশাখ উদযাপিত হয়ে আসছে। বাংলা নববর্ষের মধ্য দিয়ে সবকিছু যেন নতুনভাবে শুরু হয়। যেমন- দোকানে এই দিনে হালখাতার আয়োজন করা হয়, পূর্বের বছরের বকেয়া টাকা পরিশোধ করে ক্রেতারা মিষ্টিমুখ করেন দোকানির কাছ থেকে, দোকানি পুরনো হালখাতার হিসেব মিটিয়ে নতুন হালখাতা খোলেন। ক্রেতা-বিক্রেতার সাথে এক অনন্য মেলবন্ধন তৈরি হয়।

গ্রামের বৈশাখি আয়োজন

গ্রামে আর শহরে পয়লা বৈশাখকে ঘিরে হয়ে থাকে নানাবিধ আয়োজন। গ্রামে স্কুল-কলেজে এই দিনকে ঘিরে ছোট করে হলেও আনন্দ অনুষ্ঠান করা হয়, উপজেলা চত্বরে মঞ্চ সাজিয়ে অনুষ্ঠান করা হয়, সেখানে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা এসে নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি, এমন বিভিন্ন ধরণের সাংস্কৃতিক আয়োজনে অংশগ্রহণ করে। তবে গ্রামের পয়লা বৈশাখের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো বৈশাখি মেলা। পয়লা বৈশাখ আসার কিছুদিন আগে থেকেই সব গ্রামে মাইক বাজিয়ে ঘোষণা দেয়া হয় কবে কোথায় বৈশাখি মেলা হবে। কয়েকদিনব্যাপী বিভিন্ন জায়গায় বৈশাখি মেলা চলতে থাকে। সেসব মেলা সাধারণত গ্রামের কোনো বড় মাঠে, মোড়ে, বটতলায়, বড় কোনো গাছের তলায়, নদীর তীরের বিস্তীর্ণ জায়গায় কিংবা স্কুল কলেজের খোলা মাঠে হয়ে থাকে। নাগরদোলা, লাঠিখেলা, মোরগ লড়াই- এমন অনেক আয়োজন থাকে সেখানে। নানা ধরনের খাবার পাওয়া যায়। যেমন- কদমা, মোয়া, কাঁচাগোল্লা, নিমকি, গজা, চানাচুর, ঝালমুড়ি, আচার ইত্যাদি। শিশুদের খেলনার অনেক দোকানও বসে। সেসব দোকানে বেলুন, হাঁড়ি-পাতিল, পুতুল, ঠেলাগাড়ি, ঢোল, তবলা অনেককিছু পাওয়া যায়। কেউ কেউ বাঁশি বাজিয়ে শোনায়, এরপর যার যার খুশিমতো বংশীবাদককে টাকা দিয়ে যায়। সব মিলিয়ে গ্রামের বৈশাখি মেলা এক আনন্দের মহাসমারোহ।

শহরের নববর্ষ

শহরের বৈশাখি আয়োজন আবার অন্যরকম সুন্দর। শহরের বৈশাখি আয়োজনের প্রধান আকর্ষণ চারুকলার রঙিন মঙ্গল শোভাযাত্রা আর ছায়ানটের অনুষ্ঠান। চারুকলার শিক্ষার্থীরা দিনটিকে রঙিন করে তোলার জন্য দিনের পর দিন পরিশ্রম করে। এই দিনে চারুকলায় সারাদিনব্যাপী অনুষ্ঠান হয়। নাচে-গানে মেতে ওঠে সবাই। এছাড়া মানিক মিঞা এভিনিউতে সারারাত জেগে সুদীর্ঘ আলপনা করা হয়। আশ্চর্য সুন্দর সেই আলপনা। শহরেও পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে কয়েকদিনব্যাপী বিভিন্ন জায়গায় মেলা হয়। সেসব মেলায় শহরের ব্যস্ত মানুষরা গিয়ে প্রাণ সঞ্চারিত করে।

কেমন হবে উদযাপন?

এবার পয়লা বৈশাখ যেহেতু রমজানে, তাহলে দিনটি কীভাবে উদযাপন করা যেতে পারে? ঢাকাবাসী যাদের পক্ষে সম্ভব হবে, তারা রাত ১২ টার পর বের হয়ে মানিক মিঞা এভিনিউর আলপনা আয়োজন দেখতে যেতে পারেন কিংবা শহরের কোথায় কোথায় নানাবিধ আয়োজন চলছে, ঘুরে ঘুরে তা দেখতে পারেন। এরপর সেহরিটা বাইরেই করে নিতে পারেন। যেহেতু রোজার জন্য মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা দিনের বেলা খেতে পারবেন না, তাই চাইলে পান্তা-ইলিশের আয়োজন রাখতে পারেন সেহরিতে। অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষরা স্বাভাবিক নিয়মে পয়লা বৈশাখের সকালবেলাতেই খেতে পারেন। দিনের বেলা কারো যদি ইচ্ছে হয় বাঙালির এই প্রাণের উৎসবে অন্যান্য সকলের সঙ্গে মিলিত হবেন, তাহলে অংশগ্রহণ করতে পারেন। প্রতি বছরের মতো লাল সাদা পোশাকও পরিধান করতে পারেন, পা মেলাতে পারেন মঙ্গল শোভাযাত্রায়। তবে কারো যদি ইচ্ছে না হয়, তিনি এসব থেকে বিরত থাকতেই পারেন। আর হ্যাঁ, পয়লা বৈশাখে শুধু পান্তা-ইলিশই খাওয়া হয় না, বাঙালির ঐতিবহ্যবাহী বিভিন্ন পিঠা, ভর্তার সঙ্গে ভাত, মিষ্টান্ন, আরো নানাবিধ জিনিসও খাওয়া হয়। সেসব খাবার ভাগ করে খেতে পারেন ইফতারে ও রাতের খাবারে। 

পয়লা বৈশাখের আবেদন বাঙালির কাছে চিরকালীন। পয়লা বৈশাখ সমস্ত মলিনতা মুছে ফেলে নতুন করে হেসে ওঠার উৎসব, হাতে হাত মেলানোর উৎসব। সার্বজনীন এই উৎসব প্রতিবারের মতো এবারেও বাঙালির ঘরে ঘরে আনন্দ বয়ে আনুক। পবিত্র রমজান মাসের পরিবেশ আর বৈশাখের বর্ণিল আয়োজন মিলেমিশে তৈরি করুক একটা সুন্দর ভিন্ন আবহ।