যতবার বাড়ি ফিরি, নদীর জল, বুক ভরে নেওয়া তাজা নিঃশ্বাস আর কাদা-মাটির গন্ধ মনে করিয়ে দেয় মায়ের কথা। মায়ের সঙ্গে প্রকৃতির এক অদ্ভুত মিল। দুজনেই সমান উদার, ভালোবেসে বুকে জায়গা দেন। যতবার মায়ের মুখের দিকে তাকাই, মনে হয় এইতো পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃষ্পাপ মুখ! ইনিই তো সেই হৃদয়ের ধারণকারী, যেখানে আমার জন্য সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা জমা আছে। হাজারটা ভুল করলেও নিঃসংকোচে যিনি শুধু ক্ষমা করতে জানেন। সষ্ট্রার কাছ থেকে পাওয়া জীবনের পরম এক উপহার তিনি। পৃথিবীতে এইতো আমার সেরা আশ্রয়, সবাই ফিরিয়ে দিলেও যার কাছে ফিরতে আমার বাধা নেই। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন, ‘যার মা আছে সে কখনো গরিব নয়।’

যখন আমরা শিশু থাকি, মাকে ঘিরেই থাকে আমাদের পৃথিবী। প্রতিদিন ঘুম ভেঙে মায়ের মুখ সবার আগে দেখতে পাওয়া, ফের তার কোলেই ঘুমাতে যাওয়া। অবশ্য সম্পর্কটি তৈরি হয় আরও আগে, আত্মার সঙ্গে আত্মার। মায়ের গর্ভের নিকষ অন্ধকারেই তো আমার একটু একটু করে পূর্ণ হওয়া। তারপর একদিন মরণসম যন্ত্রণা সহ্য করে মা আমাকে পৃথিবীর আলো দেখান। আমাকে উপহার দেন একটি পরিবার, সতর্ক প্রহরীর মতো সারাক্ষণ নিরাপদ রাখেন আমার চারপাশ। আমাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে কত রাত যে নির্ঘুম কাটাতে হয় মাকে, কতবেলা পাতের খাবার শেষ না করেই উঠে পড়তে হয়। মায়ের চোখের নিচে কালি পড়ে যায়, চুলগুলো হয় উশকো-খুশকো। নিজের দিকে তাকানোর যে সময় নেই তার! পৃথিবীতে যদি কেউ আপনার জন্য এতটা কষ্ট করতে রাজি থাকেন, তবে জেনে নেবেন তিনি আর কেউ নন, আপনারই মা!

বড় হতে হতে বদলে যেতে থাকে আমাদের পরিচিত পৃথিবী। আমাদের চেনা মুখের তালিকায় যোগ হতে থাকে আরও অনেক নাম। তখন আমরা মাকে ছেড়ে একটু একটু করে দূরে যেতে থাকি। আমরা বিদ্যালয়ে যাই। সেই গণ্ডি পার হয়ে কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটি। পড়াশোনার পর্ব শেষ হলে নিজেদের ক্যারিয়ার গোছানোয় মন দিই। আমাদের আর ফেরা হয় না পুরোপুরি। মায়েরা কিন্তু সবটা জেনে-বুঝেই আমাদের ভালোবাসেন। সর্বোচ্চ ভালোবাসা দিয়ে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যান। এমন অসংখ্য মা রয়েছেন, যারা সন্তানের জন্য ঝলমলে উজ্জ্বল ক্যারিয়ার ছেড়ে এসেছেন। কেউবা অফিস আর সংসার সামলে বাকি সবটুকু সময় সন্তানের জন্য বরাদ্দ রাখছেন। 

আমরা যখন সফল হই, নিজেই বিস্মিত হই- এতটা ভালো আমার করার কথা ছিল না, এতটা সফল আমার হওয়ার কথা ছিল না। আমরা আনন্দিত-উদ্বেলিত হই। কিন্তু ধন্যবাদ জানাতে ভুলে যাই সেই মানুষটিকে যিনি না থাকলে এই পথ পাড়ি দেওয়া মোটেই সহজ ছিল না। যখন আমরা দুর্বল এক অবোধ শিশু ছিলাম, তিনিই প্রথম আমাদের কথা বলতে শিখিয়েছেন, হাতে ধরে হাঁটতে শিখিয়েছেন, শিখিয়েছেন বর্ণমালার প্রথম ভাগ। তার শেখানো ভাষায় আমরা কথা বলতে শিখি বলেই তো নিজের ভাষাকে বলা হয় মাতৃভাষা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমন হয়, আমরা যাদের শখ পূরণে ব্যস্ত থাকি তাদের তালিকায় মায়ের নাম থাকে না! অথচ আমাদের সব আবদার পূরণ করতে গিয়ে মা বিসর্জন দিয়ে এসেছেন তার অসংখ্য অপূর্ণ শখ। যেহেতু না চাইতেই সবকিছু তার কাছ থেকে পেয়ে যাই, তাই তাকে আলাদা করে ভালোবাসার কথা আমাদের মনেই থাকে না!

ছেলেবেলায় আমরা যেমন মায়ের কাছে আদরের ছিলাম, তাদের বৃদ্ধকালে আমরা কি ততটা আদরে রাখতে পারি? আদর-যত্ন দূরে থাকুক, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বছরে দুই-একবার ফেরা হয় তাদের কাছে। আমাদের মুখটি কবে দেখতে পাবেন সেই আশায় আশায় তারা পার করে দেন মাসের পর মাস। আমরা বড় হলে মায়ের প্রতি আমাদের ভালোবাসার ধরন বদলে যায়। কিন্তু যতই বড় হই না কেন, আমাদের প্রতি মায়ের ভালোবাসা কমে না, বরং বাড়তে থাকে। এই ভালোবাসাটুকু যদি আমরা বুঝতে না পারি তবে পৃথিবী আমাদের যত সফল মানুষ হিসেবেই চিনুক না কেন, বেলাশেষে আসলে আমরা ব্যর্থ। যে তার জন্মের ঋণ ভুলে যায়, মায়ের মুখ ভুলে যায়, তার আর ফেরার জায়গা কোথায়? চলুন মাকে ঠিক ততটা ভালোবাসি- যতটা ভালোবাসলে প্রতিটি দিনই হবে ‘মা দিবস’। এবার তবে মুখ ফুটে বলেই দেওয়া যাক- ‌‘তোমাকে ভালোবাসি মা’।

এইচএন/এএ