হাইকোর্টের বিতর্কিত রায় ও জুলাই গণঅভ্যুত্থান : একটি বিশ্লেষণ
সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনের সুপরিচিত সাংবাদিক মেহেদী হাসান ডালিম ‘হাইকোর্টের বিতর্কিত রায় ও জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ নামে বই লিখেছেন। বইটিতে দুটি অংশ বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে—প্রথমত কোটা বিষয়ক হাইকোর্টের রায়কেন্দ্রিক আদালত সংশ্লিষ্ট বিচারপতি-আইনজীবীদের অবস্থান এবং দ্বিতীয়ত উক্ত রায়ের প্রেক্ষিতে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের প্রতিচ্ছবি।
বইয়ে হাইকোর্টে কোটা সংশ্লিষ্ট রায়, জনমানসে প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল তা যেমন উঠে এসেছে, তেমনি শিক্ষার্থীদের রক্তঝরা দিনগুলোর প্রতিচ্ছবিও ফুটে ওঠে। লেখক বইটির শিরোনামে হাইকোর্টের বিতর্কিত রায় না লিখে ‘হাইকোর্টের তর্কিত রায়’ লিখতে পারতেন। কিন্তু সেটি তিনি করেননি, পেশাগতভাবে সাংবাদিক হলেও ব্যক্তি হিসেবে আবেগী হয়েছেন এবং ছাত্র-জনতার বিপ্লবের সময়ে সেটাই স্বাভাবিক হতে পারে। এটি তার লেখক হিসেবে স্বেচ্ছাচারিতা কিন্তু এমন শিরোনাম লেখায় ছাত্র-জনতার কাছে ভারমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছেন।
বিজ্ঞাপন
তার বিরুদ্ধে সমালোচনা বা আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আগে ভাবতে হবে দেশে কীসের তাড়নায় হাজার ছাত্র-জনতা জীবন দিলো? লেখক যে রাজনৈতিকভাবে সচেতন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। লেখকের বিরুদ্ধে আদালতে সম্মানহানির জন্য সুয়োমুটো রুল ইস্যু করার আগে ভাবতে হবে-পরপর দুটি ভোটার বিহীন নির্বাচনে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারীদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালত কেন ব্যবস্থা নেননি?
পেশাগত কারণে আইন অঙ্গনের অনেক প্রতিবেদন তিনি লিখেছেন। কিন্তু গত সরকারের নাগ পাশে থেকে নিরেট সত্য কথাগুলো জাতির সামনে বলতে বা লিখতে পারেননি। উচ্চ আদালতের বারান্দায় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো কীভাবে জাস্টিফাইড হয়েছে সেগুলো লেখার সাহস পাননি। হয়তোবা সাংবাদিক হিসেবে তিনি ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টকে ভয় পেতেন। অথবা সরকারের গোয়েন্দা বাহিনীদের হাতে নির্যাতিত-নিপীড়িত হওয়ার আশঙ্কা করতেন। এমন বৈরী আশঙ্কায় আদালতের খাস কামরার খবরগুলো সাহস করে পত্রিকায় লিখতে পারেননি। সেই ক্ষোভ থেকেই হয়তোবা এমন শিরোনাম দিয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
হতে পারে-অতীতে লেখক তৎকালীন প্রধান বিচারপতি, রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তাদের অগ্রহণযোগ্য চালচিত্র সহ্য করতে পারেননি। ফলশ্রুতিতে পট পরিবর্তনে হেতু পরিমার্জন ব্যতিরেকে গড় গড় করে সব লিখে গেছেন। এক্ষেত্রে সাংবাদিক হিসেবে তার দায় থাকলেও বিবেকের তাড়নায় সঠিক চিত্রায়নের প্রচেষ্টা ছিল।
লেখক সাবেক প্রধান বিচারপতির উন্মুক্ত আদালতে একটি মন্তব্য উদ্ধৃতি করেছেন—‘এত আন্দোলন কীসের, রাস্তায় কী শুরু হয়েছে? আন্দোলনের চাপ দিয়ে কি হাইকোর্টের রায়, সুপ্রিম কোর্টের রায় পরিবর্তন করবেন? আন্দোলন করে রায় পরিবর্তন করতে পারবেন না।’
এমন মন্তব্যে দেশের আপামর জনসাধারণের চেয়ে ব্যক্তি লেখক অনেক বেশি মর্মাহত হয়েছেন বলে আমার মনে হয়েছে। ফলশ্রুতিতে প্রধান বিচারপতি সরকারের অপরাপর ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে ওঠাবসার যে অপসংস্কৃতি চালু করেছিলেন সেগুলোও তিনি আঙুল দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেছেন।
ডিবি প্রধানের সরকারি অফিসে ভাত খাওয়ানোর যে প্রটোকল বহির্ভূত সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল সে প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতির মন্তব্যটি (‘ডিবি অফিসে যাকে তাকে ধরে নিয়ে যাবেন, তারপর খাবার টেবিলে বসাবেন। এভাবে জাতির সঙ্গে মশকরা করবেন না’) খুব গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করেছেন।
যেখানে সরকারি অফিসে এক কাপ রং চা খেতে পারাটাই সবচেয়ে বেশি সম্মানের। সেখানে হারুনের ভাতের হোটেলকাণ্ডে মাননীয় বিচারপতির এমন মন্তব্যটি দেশের সব শ্রেণিপেশার মানুষ খুশি হয়েছেন এবং সংশ্লিষ্ট মাননীয় বিচারপতির প্রতি ভালোবাসা জ্ঞাপন করেছেন।
সমালোচনার তীর সবচেয়ে বেশি নিক্ষেপ করেছেন রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তাদের ওপর। আমার কাছে মনে হয়েছে, লেখক যথার্থই দেশের উচ্চ আদালতের সীমাবদ্ধতাকে সবার সামনে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। কারণ আইন কর্মকর্তাগণ সরকারের রাজনীতির সদিচ্ছাগুলো আদালতের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করতে সহযোগিতা করেছেন যা অতীতে এমন কখনোই হয়নি।
আরও পড়ুন
ক্ষেত্র বিশেষে কথায় কথায় হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে চেম্বার জজ আদালতে অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা নিতে বেশি পটু ছিলেন এই সরকারি আইন কর্মকর্তাগণ। অনেক আইন কর্মকর্তা এভাবে সরকারের সুনজরে ছিলেন এবং পরবর্তীতে সুবিধা অনুযায়ী স্থানে পদোন্নতি পেয়েছেন।
জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার ওপরে গুলি না চালানোর রিট পিটিশন সংশ্লিষ্ট সরকার ও বিচার বিভাগের যে দৈন্যতা প্রকাশ পেয়েছে। রিটটির শুনানিতে যেসব রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তারা হইচই হট্টগোল সৃষ্টি করেছিলেন আগামী দিনে তারা বিবেকের তাড়নায় ছটফট করতে থাকবেন। সেই দিনের দৃশ্যগুলো লেখক যেভাবে বর্ণনা করেছেন তাতে সঠিকভাবে জানার সুযোগ করে দিয়েছেন।
ডিবি প্রধান মাননীয় বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করতে আসার বিষয়টি যদি সত্যি হয়ে থাকে- তাহলে এমন ধৃষ্টতা দৃষ্টিকটু নয় বরং বিচারাঙ্গন সংশ্লিষ্টদের লজ্জার বিষয়ও বটে। বিচারালয়ের প্রতি এমন ধৃষ্টতা নির্বাহী বিভাগের ব্যক্তিদের কাছে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
বইয়ে সরকারপন্থী আইনজীবীদের স্বরূপ উন্মোচন হলে তা আরও সমৃদ্ধ হতো। তৎকালীন সরকারে আস্থাভাজন ক্লিন ইমেজ সম্পন্ন অনেক আইনজীবী ছিলেন। কিন্তু জনসমর্থন বিরোধী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রতি অন্ধ সমর্থনের কারণে তাদের কদর ঋণাত্মক আকার ধারণ করেছিল।
উচ্চ আদালতে অন্দরের বিষয়গুলো যেভাবে লেখক বর্ণনা করেছেন, তা যদি সত্যি হয় তবে ভবিষ্যতে যারা সরকারকে তোষণ করার জন্য ভাবছেন-তারা সাবধানী হবেন।
লেখক উচ্চ আদালতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর যেভাবে বর্ণনা করেছেন তার একটিমাত্র ঘটনা তৎকালীন সময়ে বললে অথবা প্রকাশ করলে শ্রীঘর বা আয়নাঘরের চেয়ে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হতো। এজন্য পট পরিবর্তনের কারণে অমোঘ সত্য বিষয়গুলো লেখক কোনোটাই ধামাচাপা দেননি।
লেখক গণঅভ্যুত্থানে রাজপথের যে সমন্বিত চিত্র উপস্থাপন করেছেন, বিচার বিভাগের অন্দরের বিষয়গুলো যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে—তা প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি রাখবে। বইটি সর্বজনীন হয়ে উঠুক এই আশা ব্যক্ত করছি।
এস এম আরিফ মন্ডল ।। আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
mondolarif@yahoo.com