দুই রুমের ফ্লাটের বন্দিজীবন ভালো লাগে না ছয় বছরের তিতলির। বাবা-মা দুজনেই অফিসে। বুয়া রান্না করে চলে গেছেন। কিছুদিন দাদু এখানে ছিলেন। তখন দাদুর সঙ্গে দারুণ সময় কাটতো। দাদু খুব সুন্দর করে গল্প বলতেন। তাতেই তিতলির ঘুম চলে আসতো। কিন্তু, দাদুও চলে গেলেন। ভিডিও গেমস বা টিভিতে কার্টুন দেখতে ভালোলাগে না ওর। স্কুল খুললেও সপ্তাহে মাত্র দু’দিন। এখন করোনার ওপর খুব মেজাজ খারাপ হচ্ছে। এই একটি ভাইরাস সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছিল তিতলি।

রুহি তোমার কি খুব মন খারাপ?
হ্যাঁ, তুমি কে? তোমাকে তো দেখতে পাচ্ছি না। 
এই যে, আমি তোমার ডানপাশে আছি। একটু ঘুরে তাকাও।
তিতলি ডানে ঘুরে দেখল সুন্দর একটি গোলাপ ফুল ফুটেছে। করোনার সময় দাদু গোলাপ গাছটি তিতলিকে উপহার দিয়েছিল। খুব খুশি হয়েছিল ও। প্রতিদিন গোলাপের টবে পানি দিত তিতলি।
কী ভাবছ তিতলি? আমি গোলাপ ফুল। পরশু ফুটেছি। তুমি আমার মায়ের খুব যত্ন নিতে তাই আমি ফুটতে পেরেছি। তোমাকে ধন্যবাদ।
ও মা! ফুল আবার কথা বলতে পারে নাকি?
হ্যাঁ পারে। যারা তোমার মতো ভালো মেয়ে, তাদের সঙ্গে ফুলেরা কথা বলে। তবে, সাথে বড়রা থাকলে বলে না। আমি দু’দিন ধরে তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছি। তুমি তো একা ব্যালকনিতে এলেই না।
আচ্ছা গোলাপ তোমার মা কে?
তুমি যে গাছটিকে যত্ন নিতে ওটাই আমার মা। আর তুমি আমাকে গোলাপ বলে ডাকবে না। আমাকে ফুলবন্ধু বলবে। 
ঠিক আছে ফুলবন্ধু। 
এবার বলোতো তোমার মন খারাপ কেন?
বাসায় একা একা ভালোলাগে না। গল্প করার মতো কেউ নেই। আব্বু-আম্মু দু’জনেই অফিসে। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। 
তবে, এখন তুমি আর একা নও। আমি তো তোমার বন্ধু হয়েছি। আমার সঙ্গে গল্প করবে। দু’দিন পরে আরও গোলাপ ফুটবে। তখন আমাদের আরও বন্ধু হবে। 
তুমি গল্প বলতে পার?
পারি, তবে এখন বলব না।
কেন বলবে না?
কারণ তুমি আমার এক বন্ধুকে বন্দি করে রেখেছ। তোমার যেমন একা একা ভালোলাগে না, তারও একা একা ভালোলাগে না।
কী বলছ, আমি আবার কাকে বন্দি করে রাখলাম?
একটু ভেবে দেখলেই উত্তর পাবে...

তিতলি অনেক ভেবেও বুঝতে পারে না কাকে বন্দি করে রেখেছে।

কী বুঝতে পারলে নাতো? ঠিক আছে আমি বলব। কিন্তু আমাকে কথা দিতে হবে তুমি তাকে মুক্তি দেবে। কারণ, এখন ডিসেম্বর মাস। আর ডিসেম্বর হলো বিজয়ের মাস। এ মাসে কাউকে বন্দি করে রাখতে নেই। 
বাহ, ফুলবন্ধু তুমি তো অনেক কিছুই জানো। 
হ্যাঁ তিতলি আমি আরও জানি ১৯৭১ সালে তোমরা মুক্তি পেতে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলে। কারণ পাকিস্তান তোমাদের বন্দি করে রেখেছিল। তোমাদের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। এই যে আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলছি এই মুখের ভাষাটাও ওরা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু, নয় মাস যুদ্ধ করে তোমরা মুক্তি পেয়েছিলে।
তুমি ঠিক বলেছ ফুলবন্ধু। আমি দাদুর কাছে মুক্তিযুদ্ধের অনেক গল্প শুনেছি। আমরা দাদু যুদ্ধ করেছিল। অথচ দেখ আমি একা থাকতে থাকতে সব ভুলে যাচ্ছি।
শোনো তিতলি ইতিহাস কখনো ভুলে গেলে হবে না। মানুষের মতো মানুষ হতে হলে ইতিহাস মনে রাখতে হবে। আর ইতিহাসকে সম্মান করতে হবে। দেখ তোমার দাদুও মুক্তির জন্য যুদ্ধ করেছে। অথচ তুমি নিজে একজনকে বন্দি করে রেখেছ। তুমি যদি কথা দাও আজ তাকে মুক্তি দেবে, তাহলে আমি তার নাম বলব।
ঠিক আছে, কথা দিলাম।
তিতলি তুমি একটি ময়না পাখিকে খাঁচায় বন্দি করে রেখেছ। আচ্ছা তুমিই বলো, ময়নার কি খাঁচায় থাকার কথা। ওর তো থাকার কথা বন্ধুদের সাথে। বন্ধুদের সাথে ও গান করবে, আকাশে স্বাধীনভাবে উড়ে বেড়াবে।
তোমাকে ধন্যবাদ ফুলবন্ধু। আমি তো কখনো এভাবে ভাবিনি। দাদুও আমাকে এসব কথা বলেছিল। আমি এখনই ওকে খাঁচা থেকে মুক্ত করে দিচ্ছি। 

রুহি খাঁচার দরজা খুলে দিতেই ময়নাটি বের হয়ে ওর ঘাড়ে বসল। তারপর ‘ধন্যবাদ তিতলি’ বলে মিষ্টি সুরে সুরে গান গাইতে গাইতে উড়ে গেল।

দেখলে তো রুহি ময়না কত খুশি হয়েছে। ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশের বিজয় এসেছিল সেদিন প্রত্যেক বাঙালি এভাবেই খুশি হয়েছিল।
ফুলবন্ধু ময়নার খুশিতে আমিও খুব খুশি হয়েছি।
রুহি তোমার কাছে আমার কাছে আমার আরেকটি আবদার আছে...
আচ্ছা বলো।
বিজয় দিবস আসতে আসতে হয়তো আমি শুকিয়ে যাব। হয়তো আমি এই ডালে থাকব না। কিন্তু, আমার আরও ভাই-বোন ফুটবে। তুমি বিজয়ের দিনে আমার মায়ের টবে একটি লাল-সবুজের পতাকা পুতে দিও প্লিজ।

গোলাপের কথায় রুহির চোখ দুটি ছলছল করছিল। ঠিক তখন কলিংবেল বেজে উঠল। আব্বু ফিরে এসেছে।

আজ যাই ফুলবন্ধু, কাল আবার কথা হবে।

(বন্ধুরা কোনো পাখিকে খাঁচায় বন্দি করে রাখবে না। তোমার যেমন মুক্তভাবে ঘুরতে ভালো লাগে পাখিদেরও খোলা আকাশে উড়তে ভালো লাগে। তাই তোমরা পাখিদের বন্দি করবে না। এতে ওদের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়।)

এইচকে