মহান মুক্তিযুদ্ধে অজস্র বাঙালির শোক আর সুখের অশ্রুমাখা এক মহাসড়কের নাম-যশোর রোড। একাত্তরে পাক হানাদারের বর্বরতা থেকে নিরস্ত্র বাঙালির সীমান্ত পেরিয়ে ভারত পৌঁছে বাঁচার স্বপ্ন-সড়ক। এ পথে মিশে আছে স্বজন, সম্ভ্রম আর সহায়-সম্বলহীন নারী-পুরুষ ও শিশু শরণার্থীদের অশ্রু। যশোর রোডের প্রতিটি ধূলিকণা আজও কোটি শরণার্থীর ক্লান্তি, দুর্ভোগ ও মৃত্যুর শোক বয়ে চলেছে। 

এই সড়কের পাশেই গড়ে উঠেছিল শত শত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ও শরণার্থী শিবির। এমনকি অনেক খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক এ পথে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আবার এ সড়কই কি না ‘শিরোমণি সম্মুখসমর’-এর মতো বিখ্যাত যুদ্ধের এবং লাখো শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধার বিজয়ের মিছিল নিয়ে মাতৃভূমিতে ফেরার অভূতপূর্ব দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে আছে।

ভারতের কলকাতা শহরের শ্যামবাজার থেকে শুরু করে বারাসাত, বনগাঁ, পেট্রোপোল হয়ে বাংলাদেশের বেনাপোলের বুক চিড়ে যশোরে শেষ হওয়া এই সড়কটি উভয় দেশেই ‘যশোর রোড’ নামে পরিচিত। যশোর বকচরের জমিদার কালীপ্রসাদ পোদ্দার প্রায় ১৮০ বছর আগে তার মায়ের অনুরোধে গঙ্গাস্নানে গমনেচ্ছুদের সুবিধার্থে নির্মাণ করেছিলেন যশোর থেকে শুরু করে নদীয়ার গঙ্গাঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত এ সড়কটি। আর পুণ্যার্থীদের পথশ্রম দূর করার জন্য সড়কের দুই পাশে রোপণ করেছিলেন শত শত বৃক্ষচারা। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ সরকার যশোর শহরে অবস্থিত বিমানঘাঁটির সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার লক্ষ্যে আধুনিকভাবে সড়কটি পুনর্নির্মাণ করে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় অ্যালেন গিন্সবার্গ রচিত ১৫২ লাইনের মর্মস্পর্শী ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটির মধ্য দিয়ে দুই দেশের সীমান্ত সংযোগকারী ঐতিহাসিক এ সড়কটি বিশ্ববাসীর সামনে উঠে আসে। 

একাত্তরে যশোর রোড

যুদ্ধবিরোধী বিখ্যাত মার্কিন কবি ও সাংবাদিক গিন্সবার্গ ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে বিশিষ্ট সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কলকাতার বাড়িতে এসে তৎকালীন পূর্ববাংলায় পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতার কথা সবিস্তারে জানতে পারেন। এরপর বিবিসির রিপোর্টার গীতা মেহতা ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে সশরীরে যশোর রোড ও শরণার্থী শিবিরগুলো ঘুরে ঘুরে তার হৃদয় ভীষণভাবে ব্যথিত হয়। ফলে অক্টোবরে নিউইয়র্কে ফিরে গিয়ে তীব্র এক অপরাধবোধ থেকে নিজেকে গৃহবন্দি করে ফেলেন। পাকিস্তান ও এর বৈশ্বিক সহযোগীদের প্রতি বাংলাদেশ এবং তার জনগণের পক্ষ হয়ে তীব্র প্রতিবাদ হিসেবে নিজ করণীয় ভাবতে ভাবতেই তিনি লিখে ফেলেন এই অমর কবিতা। বাংলাদেশের অকৃত্রিম এই বন্ধু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যশোর রোডে একটি জাতির চরম দুর্দশা আর অবর্ণনীয় কষ্ট তার কবিতায় তুলে ধরে কাঁদিয়েছিলেন গোটা বিশ্বকে। একই সঙ্গে মার্কিনিদের ও বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার লক্ষ্যে কবিতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন বৈশ্বিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের নেতিবাচক ভূমিকারও তির্যক সমালোচনা করেছিলেন। 

মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ

১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর কবি ‘যশোর রোড’ কবিতাটি সেইন্ট জর্জ চার্চে ‘বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রবাসী’ শীর্ষক এক কবিতা পাঠের আসরে আবৃত্তি করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শকগণের মধ্যে তার বন্ধু বিখ্যাত সংগীতশিল্পী বব ডিলানও উপস্থিত ছিলেন। কবিতাটিতে সম্মোহিত ডিলান সে রাতেই গিন্সবার্গের বাসায় গিয়ে হাজির হন। এর মাসতিনেক আগেই নিউইয়র্কের মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এ গান গাওয়া বব ডিলান এদেশের মানুষের প্রতি আলাদা দরদ নিয়েই এবার সুরে বাঁধলেন ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন গিন্সবার্গ নিজে। আর গিটারেও ছিলেন ডিলান। ১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় কবিতাটি ‘যশোর রোড’ নামে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। যদিও সুদীর্ঘ এই কবিতাটির মাত্র অর্ধেকই পত্রিকাটিতে ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছিল। ছবি এঁকেছিলেন ড্যানিশ ব্যঙ্গচিত্র আঁকিয়ে ক্লাউস অ্যালব্রেকস্টেন।

পরবর্তী সময়ে কবিতাটি গিন্সবার্গের ‘দ্য ফল অব আমেরিকা’ কাব্যগ্রন্থভুক্ত হয়। বইয়ে কবিতার নাম বদলে রাখা হয়-‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালের ১ জুন। ১৯৭৩ সালে বইটি কবিতার জন্য আমেরিকার ‘ন্যাশনাল বুক’ অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে।

পলিয়ার ওয়াহিদ। কবি। জন্ম ২৬ ফাল্গুন। শিল্প-সাহিত্যের আকর ভূমি যশোরে। কাগুজে জন্ম ২০ মে ১৯৮৬ সালে। লেখাপড়া করেছেন মনোবিজ্ঞানে, সিলেট ও ঢাকায়। কামলা দেন প্রকাশিতব্য একটি জাতীয় দৈনিকের সংবাদ বিভাগে। বিবাহিত জীবনে ঢাকায় বসবাস করছেন।

এইচকে