বাংলাদেশের গণমাধ্যম পৃথিবীর যেকোনো রাষ্ট্রের তুলনায় বেশি স্বাধীনতা পায় বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। তিনি বলেছেন, এখানে চাইলেই যেকোনো ধরনের সংবাদ প্রকাশ করা যায়।

বৃহস্পতিবার (২ ডিসেম্বর) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গণমাধ্যম : ভূমিকা ও সংকট’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এ মন্তব্য করেন হানিফ।

তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যম আমাদের সব খবর জানার সুযোগ করে দিচ্ছে। আমরা চাই দেশের গণমাধ্যম ভালো থাকুক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আমি বলব, বাংলাদেশের গণমাধ্যম সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা পায়। চাইলেই যেকোনো খবর ছাপানো যায়। কোনো ভুল তথ্য দিয়ে দিলে সেটার জন্য ক্ষমা চাইলেই শেষ। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব বা উন্নত বিশ্বে ভুল খবরের কারণে পত্রিকার ডিকলারেশনও বাতিল হয়ে যায়।’

বি-বার্তা২৪ ডটনেট ও জাগরণ টিভির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত গোল টেবিলে বক্তব্য দেন আজকের পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান, জিটিভির প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, ডিবিসি নিউজের সম্পাদক প্রণব সাহা, ঢাকা পোস্টের সম্পাদক মহিউদ্দিন সরকার, উইমেন জার্নালিস্ট নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ-এর সমন্বয়ক আঙ্গুর নাহার মন্টি এবং বি-বার্তা২৪ ডটনেটের সম্পাদক বাণী ইয়াসমিন হাসি।

অনুষ্ঠানে বক্তারা বাংলাদেশি গণমাধ্যমের ভূমিকা ও সংকট উত্তরণ নিয়ে আলোচনা করেন। বক্তারা গণমাধ্যমের সমস্যা সমাধানে একটি নীতিমালা চূড়ান্ত করার ওপর জোর দেন।

আলোচনায় গণমাধ্যমের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেন আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব-উল আলম হানিফ। তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। কারণ গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের আগে অনেক তথ্য সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া বিনিয়োগকারীদের বেশিরভাগ সাংবাদিকতার বাইরে হওয়ায় একটি চ্যালেঞ্জ নিতে হচ্ছে সাংবাদিকদের। দেশে গণমাধ্যমের তুলনায় বিজ্ঞাপনের পরিধিও কম, যে কারণে সংকট হচ্ছে। আমি মনে করি, গণমাধ্যমকে লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন পরিধির কথা চিন্তা করতে হবে।’

গণমাধ্যম নীতিমালার ওপর জোর দিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘গণমাধ্যম নীতিমালা হওয়া খুব জরুরি। তাহলে গণমাধ্যম অনেক সংকট থেকে বের হয়ে আসতে পারবে।’

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রসঙ্গে টেনে হানিফ বলেন, ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে। অনেকে এটাকে কালো আইন বলেন, কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে যারা খারাপ কাজ করেন তাদের জন্য এটা কালো আইন। খালেদা জিয়াকে নিয়ে অনেকে কথা বলছেন, অযৌক্তিক দাবি তুলছেন। তার দণ্ড মওকুফ হতে পারে তিনি যদি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চান। তিনি দয়ালু, রাষ্ট্রের অভিভাবক; ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করে দেবেন বলে আমার বিশ্বাস।’

আজকের পত্রিকার সম্পাদক গোলাম রহমান বলেন, ‘আমরা গণমাধ্যমে অনেক কিছু লিখছি-বলছি। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পাঠক কী চায় সেটা আমরা দিতে পারছি কি না তার দিকে নজর দিতে হবে। গণমাধ্যমকে সঠিক ভূমিকা পালন করতে হবে, জনমুখী কাজ করতে হবে। গণমাধ্যম এখন নতুন প্রযুক্তিতে প্রবেশ করেছ। ডিজিটাল বা মাল্টিমিডিয়াতে অর্থাৎ একটা মোবাইলে ফোনে পুরো গণমাধ্যম পাওয়া যাচ্ছে। এতে চ্যালেঞ্জও তৈরি হয়েছে অনেক। সোশাল মিডিয়া একটা কনটেস্ট তৈরি করেছে। গণমাধ্যমকে বুঝতে হবে কীভাবে নতুন প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে হবে। গণমাধ্যমের অনেক সমালোচনা হচ্ছে বা হবে, কিন্তু গণমাধ্যমকে তার সঠিক ভূমিকাটাই পালন করতে হবে।’

গোলাম রহমান গণমাধ্যম নীতিমালা করার ওপর জোর দিয়ে বলেন, ‘গণমাধ্যমের জন্য আইনগত কাঠামো দরকার। গণমাধ্যম নীতিমালা করতে হবে। এটা করা খুব জরুরি, আর এর দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। করোনায় গণমাধ্যম যে দুর্বিসহ অবস্থায় পড়েছে সেই অবস্থানের কিছুটা পরিবর্তন হলেও পুরোপুরি হয়নি। সাংবাদিকরা বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় পড়ছেন, এগুলোর সমাধানে সরকারকে যেমন সহায়তা করতে হবে, গণমাধ্যম মালিকদেরও সহায়তা করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী না বুঝে এটা প্রয়োগ করছে কি না বা কাউকে বিপদে ফেলার জন্য করছে কি না এ বিষয়ে সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে।’

ঢাকা পোস্টের সম্পাদক মহিউদ্দিন সরকার বলেন, ‘বিশ্বে মিডিয়া এখন একটা ট্রান্সফরমেশনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমরা ট্র্যাডিশনাল মিডিয়া থেকে বের হয়ে ডিজিটাল মিডিয়ায় আছি। তবে ডিজিটাল মিডিয়াতে আমরা এখনো পিছিয়ে আছি। এখন যুগের যে চাহিদা, সেটি নিয়ে আসতে হবে। দেশে এখন অনলাইন মিডিয়ার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। মিডিয়াতে আমরা একটা সংকটকাল পার করছি। সরকার এখন পর্যন্ত অনলাইনের জন্য কোনো নীতিমালা তৈরি করতে পারেনি। এটা খুব জরুরি। বর্তমানে ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞাপন পাই আমরা। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, যে মূল্যে আমরা পাচ্ছি এটি বিশ্বের সবচেয়ে কম; নামমাত্র পয়সা দিচ্ছে তারা। দেশীয় বিজ্ঞাপনের বাজারও খুব বড় নয়। এ বিষয়ে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। উদ্যোগ না নেওয়া হলে ডিজিটাল মিডিয়া দাঁড়াতে পারবে না।’

এ সময় ঢাকা পোস্টের সম্পাদক সাংবাদিকদের ডিজিটাল মিডিয়াতে আগ্রহী হওয়ার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সাংবাদিকরা এখনো ডিজিটাল মিডিয়াকে সেভাবে গ্রহণ করছেন না। ডিজিটাল মিডিয়াতে সবাইকে জোর দিতে হবে।’

জিটিভির প্রধান সম্পাদক ইশতিয়াক রেজা তার বক্তব্যে বলেন, ‘করোনার ছোবল গণমাধ্যমকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। গণমাধ্যমকর্মীদের জীবিকা বাঁচানোর বিষয়টি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় উন্নত বিশ্ব কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে সেটা দেখতে হবে। করোনার সময়ে পত্রিকার প্রচার সংখ্যা কমেছে। এ সময়ে অনলাইনে পাঠক সংখ্যা বেড়েছে নাটকীয় হারে, টেলিভিশনের দর্শক সংখ্যাও বেড়েছে। গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে। সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিয়ে কিছুদিন আগে কাজ শুরু হয়েছে। এ দেশে একজন সাংবাদিককে নিরন্তর লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে মনোযোগ দিতে হবে।’

ডিবিসির সম্পাদক প্রণব সাহা বলেন, ‘গণমাধ্যমকে সবসময় পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রতিনিয়ত তথ্যপ্রবাহের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সাংবাদিকদের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কাজ করতে হচ্ছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলা হচ্ছে। স্বাধীন চর্চার মাধ্যম গণমাধ্যমকেই করে নিতে হবে; সরকারের, রাজনীতির সমালোচনা বা অনিয়মের সমালোচনা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে অবাধ তথ্য প্রবাহে সহযোগিতা করতে হবে। সংবাদমাধ্যম পরিবর্তনের জায়গা, এখন সবই ডিজিটাল মিডিয়া। এই যে পরিবর্তন এটার সঙ্গে চলতে পারাটাও সাংবাদিকতা।’

ডব্লিউজেএনবির সমন্বয়ক আঙ্গুর নাহার মন্টি বলেন, ‘সাংবাদিকতা ও সংবাদকর্মীরা জনবিচ্ছিন্ন। গণমাধ্যম এখনো সোশাল মিডিয়ার অপপ্রচার ঠেকাতে পারছে না। এ সমস্যা সমাধানে সবার ভূমিকা দরকার, না হলে গণমাধ্যম মুখ থুবড়ে পড়বে। গণমাধ্যম মুখ থুবড়ে পড়লে সরকার ও দেশের ক্ষতি হবে। আমরা মানুষের জন্য কথা বলি অথচ আমাদের সাংবাদিকদের জন্য কথা বলার কেউ নেই। তাছাড়া গণমাধ্যমের কনটেন্ট নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।’

সমাপনী বক্তব্যে সম্পাদক বাণী ইয়াসমিন হাসি বলেন, ‘গণমাধ্যমে সংকট থাকবে, চাপ থাকবে। এই চাপ বা সংকট আমাদেরকেই মোকাবিলা করতে হবে। চাপের কথা বলা হয়, এটা কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে নয়।’

গোলটেবিলে সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করেন জাগরণ টিভির প্রধান সম্পাদক এফ এম শাহীন।

এনআই/জেডএস/ওএফ/জেএস