মাঠপর্যায় থেকে গ্রাহক ও অর্থ সংগ্রহে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে তিন শতাধিক কর্মী নিয়োগ করে শাহ সুলতান মাল্টিপারপাস নামে একটি কোম্পানি। পাশাপাশি সুদবিহীন ১২ থেকে ১৬ শতাংশ মুনাফার কথা বলে গ্রাহকদের বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করে। এভাবে প্রায় দুইশ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতিষ্ঠানটি।

এ ঘটনায়  শাহ সুলতান মাল্টিপারপাস নামে ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান শাহ আলমসহ পাঁচজনকে নরসিংদী থেকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। র‍্যাবের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক সুদবিহীন ব্যবসার লোভ দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটি দ্রুত আস্থার জায়গা তৈরি করে। আর এভাবেই কয়েক হাজার গ্রাহক হারান প্রায় দুইশ কোটি টাকা।  

রোববার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, নরসিংদীর পাঁচ থেকে ছয় হাজার সাধারণ পেশাজীবী অতিরিক্ত লাভের আশায় এ প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। চক্রের সদস্যরা প্রায় ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান। 

তিনি বলেন, একদিকে করোনা মহামারিতে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক দৈন্যদশা অপরদিকে বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বনটুকু হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন ভুক্তভোগীরা। এ পরিস্থিতিতে তারা গচ্ছিত টাকা ফিরে পাওয়ার আশায় স্থানীয় সমবায় অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। জেলা সমবায় অধিদপ্তর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন।

২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে শাহ সুলতান মাল্টিপারপাস নামে ওই প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যালয় বন্ধ করে দেয়। পরিচালনা পর্ষদের সবাই গা ঢাকা দিলে বিষয়টি নিয়ে নরসিংদী জেলায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ, প্রতিবাদ সভা, মানববন্ধনসহ চলতে থাকে। এ ঘটনায় নরসিংদী জেলার পলাশ থানা পুলিশ প্রাথমিকভাবে লিখিত অভিযোগ নেয়। বিস্তারিত অনুসন্ধান শেষে অভিযোগটি মামলা আকারে লিপিবদ্ধ হয়।  

মামলার পাশাপাশি ভুক্তভোগীরা জেলা প্রশাসন ও সমবায় অধিদপ্তরে অভিযোগ দেন। তারা আইনি সহযোগিতার জন্য র‌্যাব-১১ এর কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ করেন। র‌্যাব ছায়া তদন্ত ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়। র‌্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১১ এর অভিযানে শনিবার রাতে নরসিংদী সদর থানা এলাকায় গোপন বৈঠক চলাকালে প্রতারক চক্রের অন্যতম হোতা মো. শাহ আলম, সহযোগী দেলোয়ার হোসেন শিকদার, মো. সুমন মোল্লাহ ও হান্নান মোল্লাহকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, ২০১০ সালে নরসিংদী জেলার সদর থানার চিনিশপুর ইউনিয়নের ঘোড়াদিয়া এলাকায় শরিয়াহভিত্তিক শাহ সুলতান মাল্টিপারপাস কোম্পানির প্রধান কার্যালয় স্থাপন করে একটি প্রতারক চক্র। চক্রটি সুকৌশলে ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সুদমুক্ত ব্যবসার লোভ দেখিয়ে বিভিন্ন পেশার মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে। ধর্মের দোহাই দিয়ে সাধারণ জনগণকে তাদের সংস্থার সদস্য করা হতো। সুদমুক্ত জীবন যাপন ছিল তাদের প্রতিষ্ঠানের লোক দেখানো মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।

চক্রের অন্যতম হোতা শাহ আলম নিজে কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে চারটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। পরে ২৪ জন জনবলের সমন্বয়ে পরিচালনা পর্ষদ গঠন করেন এবং অতিরিক্ত ২০ জন পরিচালক নিয়োগ দেন। আত্মীয় বা পরিচিতদের পরিচালক ও পরিচালনা পর্ষদে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে নরসিংদী জেলার বিভিন্ন থানার জনবহুল ও ব্যবসায়িক এলাকায় জাঁকজমকপূর্ণ শাখা অফিস স্থাপন করে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো, শাহ সুলতান এম সি এস  কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি., স্বদেশ টেক্সটাইল লি., শাহ সুলতান টেক্সটাইল লি. ও শাহ সুলতান প্রপার্টিজ লি.

জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, মাঠ পর্যায়ে গ্রাহক ও অর্থ সংগ্রহের জন্য তাদের তিন শতাধিক কর্মী রয়েছে। তাদের কোনো বেতন দেওয়া হয় না। তাদের নিয়োগ দেওয়া হতো কমিশন ভিত্তিতে। গ্রেপ্তাররা বিনিয়োগকারীদেরকে বার্ষিক ১২ থেকে ১৬ শতাংশ মুনাফার প্রলোভন দেখায়। এছাড়াও তারা গ্রাহকদের কাছ থেকে উচ্চ মুনাফায় মাসিকভিত্তিতে ডিপিএস এর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে। 

র‍্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান না হলেও তারা ব্যাংকের মতই গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ ও ঋণ দেওয়ার কার্যক্রম পরিচালনা করত। গ্রাহকদের অর্থ ল্যান্ড প্রজেক্ট, টেক্সটাইল ও নিজস্ব অন্যান্য ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে সাধারণ গ্রাহকদের কষ্টার্জিত অর্থ আত্মসাৎ করে। তারা এ পর্যন্ত প্রায় ২০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে বলে জানা গেছে। তবে সংগৃহীত টাকার পরিমাণ আরও বেশি  হতে পারে। 
    
কমান্ডার মঈন বলেন, করোনাকালে মানুষের টাকার প্রয়োজন পড়ে। এসময় বিনিয়োগকারীরা শাহ সুলতান মাল্টিপারপাস থেকে টাকা উত্তোলনের আবেদন করেন। তখনই তারা করোনা সহ বিভিন্ন অজুহাতে টাকা ফেরত দিতে গড়িমসি শুরু করে। প্রতিষ্ঠানের এমডি ওমর ফারুক ও ডিএমডি মাসুদ রানা গ্রাহকদের বিনিয়োগের টাকা দিয়ে নরসিংদীর বিভিন্ন স্থানে পাঁচ থেকে ছয় একর জমি নিজেদের নামে কিনেছেন। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির নামে নরসিংদীসহ বিভিন্ন স্থানে সাত-আট একর জমি রয়েছে বলে জানা যায়। 

টাকা ফেরতের জন্য গ্রাহকদের ক্রমাগত চাপ বৃদ্ধি বাড়তে থাকায় সংশ্লিষ্টরা প্রতিষ্ঠানটিতে তালা ঝুলিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়। গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।

জেইউ/আরএইচ