সারিদ ফেরদৌস অনন, ঢাকার খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা। দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর কাঙ্ক্ষিত ড্রাইভিং লাইসেন্সটি হাতে পান। তবে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) কার্যালয়ের কাউন্টার থেকে সেটি হাতে নিয়ে আঁতকে ওঠেন। নিজের নাম, জন্ম তারিখ, বাবার নাম ঠিক থাকলেও ছবিটা কার? ভালো করে লক্ষ করেন, ছবির নিচের স্বাক্ষরও তার নয়! 

ইকুরিয়া বিআরটিএ কার্যালয় থেকে লাইসেন্স নেওয়ার পর সেই কাউন্টারে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন অনন। তারা নিয়ম অনুযায়ী সংশোধনী/নবায়ন ফি-সহ নতুন করে সঠিক তথ্য জমা দিয়ে আবেদন করতে বলেন। যদিও অননের বায়োমেট্রিক স্লিপ অনুযায়ী তার তথ্য সঠিক ছিল। তাহলে ভুলটা কার? 

ভুল ছবি ও স্বাক্ষরের লাইসেন্স নিয়ে দেড় মাস ধরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্বারে দ্বারে ঘোরেন অনন। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি। সর্বশেষ বিআরটিএ’র এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। জানান তার সমস্যার কথা। ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘এমন তো কখনও দেখিনি। ইকুরিয়া বিআরটিএ বরাবর অভিযোগ করুন, দেখি কী হয়

ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে জানা যায়, অননের লাইসেন্সে ব্যবহৃত ছবিটি সাঈদ আহমেদ নামের এক ব্যক্তির। যদিও ওই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি ঢাকা পোস্ট। আর স্বাক্ষরটি ছিল শাহজাহান ফিরোজের। 

বিআরটিএ কর্তৃক সারিদ ফেরদৌস অননের ড্রাইভিং লাইসেন্সের প্রাপ্তি স্বীকার রশিদ / ছবি- ঢাকা পোস্ট

ভুল ছবি ও স্বাক্ষরের লাইসেন্স নিয়ে দেড় মাস ধরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্বারে দ্বারে ঘোরেন অনন। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি। সর্বশেষ বিআরটিএ’র এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। জানান তার সমস্যার কথা। ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘এমন তো কখনও দেখিনি। ইকুরিয়া বিআরটিএ বরাবর অভিযোগ করুন, দেখি কী হয়?’ 

ঢাকা পোস্টকে অনন জানান, ২০২১ সালের জুনে হালকা যানবাহন ও মোটরসাইকেলের অপেশাদার লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেন। দ্বারে দ্বারে হোঁচট খেয়ে বর্তমানে ভুল ছবি ও স্বাক্ষরের লাইসেন্স নিয়েই গাড়ি চালাচ্ছেন। 

সারিদ ফেরদৌস অনন বলেন, ২০২১ সালের মাঝামাঝিতে (জুন) কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়ায় (ঢাকা মেট্রো- ২ সার্কেল) অবস্থিত বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) কার্যালয়ে লিখিত, মৌখিক ও প্র্যাকটিক্যাল (ব্যবহারিক) পরীক্ষা দিই। সব পরীক্ষায় পাস করার পর তারা আমাকে ছবি ও আঙুলের ছাপ দেওয়ার জন্য ২৯ জুন তারিখ নির্ধারণ করে দেয়। 

ছবি তোলার জন্য মিরপুর- ১২ নম্বরের আড়ং বিল্ডিংয়ের ‘মাদ্রাস সিকিউরিটি প্রিন্টার্স’ (সিইএস) কার্যালয়ে যান। সেখানে ছবি তোলার তারিখ ২৯ জুন থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি সেদিন ছবি ও বায়োমেট্রিক সংগ্রহ করেনি। প্রচুর ভিড় থাকায় তারা পরের দিন যেতে বলেন। ৩০ জুন যাওয়ার পর তারা লাইসেন্স ও পরীক্ষার কাগজপত্র পরীক্ষা করে ছবি ও আঙুলের ছাপ নেয়। 

বায়োমেট্রিক সম্পন্নের পর সম্ভাব্য ২৬ অক্টোবর ২০২২ তারিখে লাইসেন্স দেওয়া হবে বলে জানানো হয় আননকে / ছবি- ঢাকা পোস্ট

অনন বলেন, নভেম্বরের ৩ তারিখে লাইসেন্স দেওয়ার কথা ছিল। তারিখ অনুযায়ী বিআরটিএ কার্যালয়ে গেলে তারা আমার স্লিপে ২৬ অক্টোবর ২০২২ এর মধ্যে ‘লাইসেন্স পাব’ উল্লেখ করে সিল মেরে দেয়। কিন্তু সিল দেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে আমার ‘লাইসেন্স কার্ড প্রস্তুত’ বলে মেসেজ পাই। চলতি বছরের জানুয়ারিতে আমি কার্ডটি গ্রহণ করি। কার্ড গ্রহণের পর ভুল ছবি ও স্বাক্ষর দেখে সঙ্গে সঙ্গে কাউন্টারে জানাই। তবে, তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। 

সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলি। উনিও কোনো সমাধান দিতে পারেননি। বলেন, ‘এমন কাহিনি তো কখনও হয়নি। এটার কোনো সমাধান নাই। তবুও আপনি বিষয়টি অবগত করে দরখাস্ত করতে পারেন। সমাধান কী, আমার জানা নেই। সময় লাগবে।’ 

তবে, বিআরটিএ’র অপর এক কর্মকর্তা অননকে বলেন, আবেদনের পর আবার পরীক্ষা দিয়ে রি-প্রিন্টের (সংশোধনপূর্বক পুনরায় প্রিন্টের আবেদন) জন্য দেওয়া হতে পারে। সেক্ষেত্রে তাকে আবার টাকা দিতে হবে। ‘কিন্তু ভুল তো আমার নয়, নতুন করে কেন টাকা দিতে যাব’— এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এবং সমস্যার সমাধান পেতে বিআরটিএ কর্তাদের পেছন পেছন ঘুরতে থাকেন অনন। কিন্তু কোনো সমাধান দিতে পারেননি কেউ। বাধ্য হয়েই ভুল ছবি ও স্বাক্ষর করা লাইসেন্স নিয়ে রাস্তায় নামেন তিনি। 

বিআরটিএ জানায়, ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে দুই ধাপে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ছবির প্রয়োজন হয়। প্রথম ধাপে একটি পাসপোর্ট সাইজের ছবি দিয়ে আবেদন করতে হয়। পরবর্তীতে বায়োমেট্রিকের সঙ্গে আবারও ছবি তুলতে হয়। কিন্তু অননের ক্ষেত্রে কোনো পর্যায়ের ছবিই ব্যবহৃত হয়নি। শুধু অনন নন, ছবি-সংক্রান্ত লাইসেন্সের সমস্যা হয়েছে এমন তিনজনের তথ্য রয়েছে ঢাকা পোস্টের কাছে। 

ভুল ছবি ও স্বাক্ষর দেওয়া সারিদ ফেরদৌস অননের ড্রাইভিং লাইসেন্স / ছবি- ঢাকা পোস্ট

কেন এমন হচ্ছে? এর সমাধান কোথায়— জানতে চাইলে বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক (ঢাকা জেলা) তন্ময় কে. ধর ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এমন দু-একটা অভিযোগ পেয়েছি। এগুলো কেস টু কেস সমাধান করা হচ্ছে। লাইসেন্সের জন্য ডেটা এন্ট্রির কাজ মূলত ঢাকায় (মহাখালী) হয়। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে পুরোপুরি তদারকি করতে পারি না। এটা সম্পূর্ণ টেকনিক্যাল বিষয়। মিসম্যাচ (অমিল) কীভাবে হলো, সেটা বলতে পারছি না।’ 

‘কেউ যদি এমন সমস্যা নিয়ে ইকুরিয়াতে আসেন, আমরা লাইসেন্সের সঙ্গে তাদের দেওয়া আগের তথ্যগুলো মিলিয়ে দেখব। এরপর ব্যবস্থা নেব’— বলেন এ কর্মকর্তা। 

লাইসেন্সে ছবি ও স্বাক্ষর পরিবর্তন হওয়া চারজনই মাদ্রাস সিকিউরিটি প্রিন্টার্সে তাদের তথ্যগুলো জমা দিয়েছেন। এখানে কাদের ভুল— জানতে চাইলে মাদ্রাস সিকিউরিটি প্রিন্টার্সের পক্ষ থেকে কারও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাদ্রাস সিকিউরিটি প্রিন্টার্স শুধুমাত্র তথ্য সংগ্রহ করে। তথ্য নিয়ে বিআরটিএ-কে দেয়। লাইসেন্স ইস্যু সংক্রান্ত দায়িত্ব বিআরটিএ’র। এখানে লাইসেন্সের ভুল নিয়ে কোনো অভিযোগ গ্রহণ করা হয় না। এ বিষয়ে মন্তব্য করার কোনো অথরিটি (কর্তৃপক্ষ) আমাদের নেই। 

এদিকে, অননের মতো যারা বিআরটিএ’র ভুল তথ্যের লাইসেন্স নিয়ে সড়কে যানবাহন চালাচ্ছেন তারা যেকোনো সময় ট্রাফিকের মামলায় জেল-জরিমানার মুখোমুখি হতে পারেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক পূর্ব জোনের সার্জেন্ট মিনহাজ আহমেদ এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মানুষের চেহারার পরিবর্তন হতেই পারে। আমরা যখন সড়কে কোনো চালকের লাইসেন্স পরীক্ষা করি তখন আংশিক মিল থাকলেও লাইসেন্সটি তার বলে ধরে নিই। তবে, চেহারার সঙ্গে লাইসেন্সের ছবির কোনো মিল যদি না পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে সেটা ভুয়া লাইসেন্স হিসেবে ধরা হয়। সড়ক পরিবহন আইন- ২০১৮ অনুযায়ী, কেউ যদি মোটরযান চালানোর সময় নকল, জাল ও ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যবহার করেন তাহলে তার সর্বনিম্ন ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড, এক লাখ থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা কিংবা উভয়দণ্ড হতে পারে।’
 
এআর/এমএআর//