যেখানে থেকে বিনামূল্যে সবজি নিতে পারেন দরিদ্ররা
‘যাদের সবজি কেনার সামর্থ্য নেই, তারা আমার দোকান থেকে বিনামূল্য কিছু সবজি নিতে পারেন।’ এ-ফোর সাইজের কাগজে লেমিনেটিং করা এমন একটি লেখা নিজের দোকানে লাগিয়ে দিয়েছিলেন চট্টগ্রামের গরীবুল্লাহ হাউজিং সোসাইটির কাঁচা বাজারের সবজি দোকানি ইব্রাহিম। শুধু কাগজ লাগিয়েই দায়িত্ব শেষ করেননি, প্রতিদিন চার-পাঁচ জনকে বিনামূল্যে সাধ্য অনুযায়ী সবজিও দেন তিনি।
ইব্রাহিমের এমন কাজ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে এসেছেন চট্টগ্রামের কিছু যুবক। তার ফ্রি সবজি দেওয়ার ধারণা থেকে চট্টগ্রামের বাজারে বাজারে সবজি ডোনেট বক্স বসেছে ‘মসাইদাহ’ নামে একটি সংগঠন ও কিছু যুবক। সংগঠনটির উদ্যোক্তা মো. আবু হাসান ও ব্যবসায়ী কায়সার আলম চৌধুরী অন্য কয়েকজনের সহযোগিতায় বর্তমানে চট্টগ্রামের ১৪টি বাজারে বসেছে ব্যতিক্রমী সবজি ডোনেট বক্স। এসব ডোনেট বক্স রাখা হয়েছে সবজির দোকানে। এতে লেখা ‘যাদের সামর্থ্য আছে, তারা ডোনেট বক্সে সবজি রাখবেন। আর যাদের সবজি কেনার টাকা নেই, তারা ডোনেট বক্স থেকে সবজি নিতে পারেন।’
বিজ্ঞাপন
এ উদ্যোগে প্রচুর সাড়াও পড়েছে বলে জানান উদ্যোক্তারা। ১৪টি বাজারের ডোনেট বক্সে অনেক ক্রেতা সবজি রেখে যাচ্ছেন। সেখান থেকে কমপক্ষে ১০০ জন দরিদ্র মানুষ বিনামূল্যে সবজি নিয়ে যান।
বিজ্ঞাপন
ফ্রি সবজি দেওয়ার আইডিয়া কীভাবে এলো জানতে চাইলে চট্টগ্রামের গরীবুল্লাহ হাউজিং সোসাইটির কাঁচা বাজারের সবজি দোকানি ইব্রাহিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি ব্রুনাইয়ে ছিলাম। সেখানে দেখেছি রমজান মাস এলে সব শপিং মলের সামনে বাস্কেট বসতো। সেখানে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী জিনিসপত্র রাখত। যার প্রয়োজন হতো ফ্রিতে সবজি নিয়ে যেত। কিন্তু কাউকে খুঁজে নিতে হতো না। যাদের ইচ্ছে হতো তারা নিয়ে যেত।’
‘আমার জটিল একটি রোগ ধরা পড়ে। এরপর আমি ব্রুনাই থেকে দেশে চলে আসি। আমাকে হুইল চেয়ারে বসে দেশে আসতে হয়েছে করোনার সময়। পুরো শরীরের হাড় ক্ষয়ে গিয়েছিল, বাঁচব ভাবিনি। আল্লাহ মৃত্যুর পথ থেকে ফিরিয়েছেন। অসুস্থ থাকা অবস্থায় পরিকল্পনা করছিলাম সুস্থ হলে মানুষের জন্য কিছু করব।’
সুস্থ হয়ে গরীবুল্লাহ হাউজিং সোসাইটির কাঁচা বাজারে সবজির দোকান দেন বলে জানান ইব্রাহিম। তিনি বলেন, ‘দোকান দিয়ে খেয়াল করলাম সবজির দাম অনেক। অনেক সময় অনেক কাস্টমার আসে। দামের কারণে পরিমাণ মতো অনেক কাস্টমার সবজি নিতে পারে না। আবার অনেকে না নিয়ে চলে যায়।’ এ নিয়ে খারাপ লাগত তার।
ইব্রাহিম বলেন, ‘দাম কিন্তু সবার জন্য না। যারা দরিদ্র মানুষ তাদের কাছে সবজির দাম বেশি বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। পরে আমি ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু মানুষকে সবজি দেওয়া শুরু করি।’
‘প্রায় দুই মাস আগে আমি ফ্রিতে সবজি দেওয়া শুরু করি আমার সামর্থ্য অনুযায়ী। এরপর আমি দোকানে একটি ফেস্টুন টানিয়ে দেই। যার মধ্যে লেখা ছিল— যাদের সবজি কেনার সামর্থ্য নেই, তারা আমার দোকান থেকে বিনামূল্য কিছু সবজি নিতে পারেন। এভাবে প্রায় দুই মাস দৈনিক ৩০০ টাকার সবজি ছয়-সাত জন মানুষকে ফ্রিতে দিয়ে আসছি। যাদের কেনার সামর্থ্য নেই, তাদেরকেই ফ্রিতে সবজি দেওয়া হয়। এটা জেনে আবু হাসান ভাই ফেসবুকে দেন। তা দেখে কায়সার ভাই আসেন। তারা এসে আমার দোকানে সবজি ডোনেট বক্সও সেট করে দেন। সেখানে এখন কিছু সবজি রেখে যান ক্রেতারা।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এটা দেখে অন্য সবজির দোকানে ডোনেট বক্স বসেছে শুনে ভালো লাগছে। আগে যেখানে প্রতিদিন দরিদ্র চার-পাঁচ জন মানুষ সবজি নিতে আসতেন। প্রচার হওয়ার পর এখন প্রতিদিন ১০-১৫ জন মানুষ আসে সবজি নিতে। কিন্তু বাজারে আসা সব ক্রেতা তো ডোনেট বক্সে সবজি রাখে না। মানুষ বেশি আসায় সবাইকে দেওয়া আমার জন্য কষ্ট হয়ে যাই। তারপরও কাউকে খালি হাতে ফেরত যেতে দেইনি। সবজি নিয়ে তারা আমার জন্য দোয়া করেন, এটাই তো পাওয়া।’
এদিকে চট্টগ্রামের ১৪টি বাজারে সবজি ডোনেট বক্স স্থাপন করেছে স্থানীয় সংগঠন ‘মসাইদাহ’। সংগঠনটির উদ্যোক্তা মো. আবু হাসান ও ব্যবসায়ী কায়সার আলম চৌধুরী কয়েকজনের সহযোগিতায় বিভিন্ন এলাকায় বসিয়েছেন সবজি ডোনেট বক্স। এ উদ্যোগের ফলে দোকানের বাইরে রাখা প্লাস্টিকের ক্যারেট বক্সে ক্রেতারা সাধ্যমতো সবজি রেখে যাচ্ছেন। আর যাদের সামর্থ্য নেই তারা নিচ্ছেন প্রয়োজন মতো। এ উদ্যোগ সাড়া ফেলেছে চট্টগ্রামে।
জানা গেছে, গত ৯ মার্চ চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী থানার শাহ গরীবুল্লাহ হাউজিং সোসাইটির কাঁচাবাজারে প্রথম ডোনেট বক্স স্থাপন করা হয়। সাড়া পেয়ে ধাপে ধাপে নগরীর চকবাজার, পূর্ব বাকলিয়া, কামাল বাজার, মোহরা, হাটহাজারীর মদুনাঘাট, নজুমিয়া হাট, সাবান ঘাটা, রাহাত্তারপুল, কালামিয়ার বাজারসহ মোট ১৪টি স্থানে সবজি ডোনেট বক্স চালু করা হয়।
এসব বাজারে সবজি ডোনেট বক্স স্থাপনের উদ্যোক্তা মো. আবু হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের ১৪টি বাজারে সবজি ডোনেট বক্স স্থাপন করেছি। ইব্রাহিমের ফ্রি সবজি দেওয়া দেখেই মূলত আমার মাথায় ফ্রি ডোন্ট বক্সের আইডিয়াটা আসে। হযরত উসমান (রা.) রুটির ঝুড়ি প্রথা চালু করেছিলেন। ছোট বেলায় দেখতাম, ভাত রান্নার চাল থেকে প্রতি বেলায় মা একমুঠো চাল আলাদা করে রাখতেন গরিবদের জন্য। এসব চিন্তা থেকে মাথায় আসে সবজি ডোনেট বক্সের। যেখানে সবজির দোকানে একজন ক্রেতা কিছু সবজি রেখে দেন, তাতে দরিদ্র মানুষের এক বেলার তরকারির জোগান হয়।’
‘যে এরিয়াতে সবজি ডোনেট বক্স বসানো হয়, তার আগে ওই এলাকার দোকানি ও মানুষের সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে কথা বলি। কেউ দায়িত্ব নিলে বা মনিটরিং করতে চাইলে ডোনেট বক্স স্থাপন করি। প্রথমে আমরা প্লাস্টিকের ক্যারেট বক্স দিচ্ছি। এরপর সঙ্গে ফেস্টুন দিয়ে লিখে দেই। প্রথমবার আমরা নিজেরা কিনে সবজি দেই। এভাবে আমরা একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।’
তিনি বলেন, ‘সবজি ডোনেট বক্স স্থাপনের পর সাধারণ মানুষই প্রতিদিন সবজি রেখে যায় ডোনেট বক্সে। প্রথম দিন ৩০০ টাকার সবজি কিনে দিয়েছিলাম ডোনেট বক্সে। এরপর আর কিনে দিতে হয়নি। মানুষজনই উৎসাহী হয়ে ডোনেট বক্সে সবজি দিয়ে যাচ্ছেন। আর যাদের প্রয়োজন হচ্ছে তারা নিয়ে যাচ্ছেন। এরপরও কিছু জায়গায় আমার ফোন নম্বর দিয়ে আসছি। যদি ডোনেট বক্সে সবজি না থাকে তারা আমাকে ফোন দেন। তখন আমি টাকা পাঠিয়ে দেই সবজি কিনতে। তবে এখন দিতে হয় না। এলাকার মানুষই ডোনেট বক্সে সবজি রাখেন।’
দোকানে ডোনেট বক্স স্থাপনের শুরুটা খুব সহজ ছিল না বলে জানান আবু হাসান। তিনি বলেন, ‘সবজি দোকানদের বুঝিয়ে ডোনেট বক্স রাখতে হয়। হুট করে রাখা যায় না। তিন-চার দিন গিয়ে বুঝিয়ে তারপর রাখতে হয়। যেমন মদুনাঘাট বাজারে কোনো সবজি দোকানদার ডোনেট বক্স রাখতে দেয়নি। পরে সেখানকার ক্রোকারিজ দোকানি জায়গা দিয়েছিল। সেখানে সবজি ডোনেট বক্স রাখি। যেটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছিল। সবজি দোকানিদের উপকারিতা বুঝিয়ে ডোনেট বক্স রাখতে হয়। তবে এলাকার মানুষ ও বাজার কমিটির সহযোগিতা পেলে কাজটি সহজ হয়।’
‘এই সবজি ডোনেট বক্স চট্টগ্রামের পর কুমিল্লা ও রাঙামাটিতে স্থাপন করা হয়েছে। রমজান মাসে গ্রোসারি দোকানেও গ্রোসারি ডোনেট বক্স স্থাপন করার চিন্তা-ভাবনা আছে। সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি, প্রথম রমজান থেকে চালু করার পরিকল্পনা আছে।’
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি এলাকার সবজি ডোনেট বক্সে প্রতিদিন ৮-১০ কেজি সবজি জমা হয়। আর বিনামূল্যে ১০-১৫ জন দরিদ্র মানুষ সবজি নেন রান্নার জন্য। বেগুন, মিষ্টি কুমড়া, লাউ, কাঁচা মরিচ, টমেটো, আলু, শসা, লালশাকসহ নানা সবজি ডোনেট বক্সে জমা হয়। প্রতিদিন কমপক্ষে ১০০ জন গরীব মানুষ ১৪ জায়গায় স্থাপন করা ডোনেট বক্স থেকে ফ্রিতে সবজি নিতে পারছেন বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তা আবু হাসান।
সারওয়ার আলম নামে এক ব্যক্তি চট্টগ্রাম নগরীতে স্থাপন করা একটি ডোনেট বক্সে সবজি রেখেছেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘উদ্যোগটি খুবই ভালো। এতে কিছু মানুষের উপকার হবে।’
চান্দগাঁও মোহরা এলাকার গৃহবধূ তানজিনা আকতার বলেন, ‘উদ্যোগটা আমার অনেক ভালো লেগেছে। আমার সামর্থ্য থাকায় বাজার করে চার থেকে পাঁচ পদের সবজি ডোনেট বাক্সগুলোতে রেখে এসেছি।’
ডোনেট বক্স থেকে সবজি নিয়েছেন খালেদা বেগম নামের এক নারী। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বক্স থেকে দুই বেলা খেতে পারব এমন সবজি নিয়েছি বিনা পয়সায়। খুব খুশি হয়েছি। যারা এমন আয়োজন করেছেন তাদের জন্য দোয়া করি।’
কেএম/এসএসএইচ