মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যার জন্য ঘটনার ৫ দিন আগে ‘কন্ট্রাক্ট’ (চুক্তি) করে মাসুম মোহাম্মদ আকাশ নামে এক পেশাদার খুনি। তিন দিন আগে সে নাম পায় কাকে খুন করতে হবে। ঘটনার আগের দিন টিপুকে কমলাপুরে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় সে। হত্যাকাণ্ডের জন্য টাকা নয়, আগের কয়েকটি মামলা তুলে নেওয়াসহ বিশেষ সুবিধার নিশ্চয়তা দেওয়া হয় তাকে।

রোববার (২৭ মার্চ) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ডিএমপি’র (গোয়েন্দা) অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার। 

তিনি বলেন, জাহিদুল ইসলাম টিপু ও সামিয়া আফরান প্রীতিকে গুলি করে হত্যাকারী শুটারের নাম মাসুম মোহাম্মদ আকাশ (৩৪)। সে চাঁদপুরের মতলব উপজেলার কাইশকানি এলাকার মোবারক হোসেনের ছেলে। রাজধানীর পশ্চিম মাদারটেকের ৬০/১৫ বাসায় পরিবার নিয়ে থাকে সে। তার নামে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় হত্যাসহ চারটি মামলা রয়েছে।

বগুড়া জেলা পুলিশের সহযোগিতায় ডিএমপি’র গোয়েন্দা শাখার মতিঝিল বিভাগের খিলগাঁও জোনাল টিম বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে বগুড়া থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে।

হাফিজ আক্তার বলেন, গত ২৪ মার্চ রাত ১০টা ২০ মিনিটের দিকে মতিঝিল এজিবি কলোনি থেকে বাসায় যাওয়ার পথে শাহজাহানপুর থানার আমতলা এলাকায় অজ্ঞাত অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী পূর্ব পরিকল্পিতভাবে হত্যা করার উদ্দেশে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করে জাহিদুল ইসলাম টিপু ও তার ড্রাইভার এবং রিকশা আরোহী সামিয়া আফরান প্রীতি নামের এক মেয়েকে গুরুতর জখম করে। তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক জাহিদুল ইসলাম টিপু ও রিকশা আরোহী প্রীতিকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই ঘটনায় শাহজাহানপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। গোয়েন্দা মতিঝিল বিভাগ ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে।

ঘটনার আগের দিন প্রথম হত্যার চেষ্টা

হাফিজ আক্তার বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শুটার আকাশ জানিয়েছে, ঘটনার আগের দিন ২৩ মার্চ জাহিদুল ইসলাম টিপুকে তার এজিবি কলোনির রেস্টুরেন্ট থেকে বাসায় যাওয়ার রাস্তায় অনুসরণ করে গুলি করার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু বেশি লোকজন থাকায় সে ব্যর্থ হয়।

অনুসরণ করে শাহজাহানপুরে এসে হত্যা

ঘটনার দিন ২৪ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে একজন ফোন করে মাসুমকে জানায়, টিপু তার অফিসে (রেস্টুরেন্ট) অবস্থান করছে। এ সংবাদ পেয়ে মাসুম জাহিদুল ইসলাম টিপুর রেস্টুরেন্টের কাছ থেকে টিপুকে অনুসরণ করা শুরু করে এবং গুলি করার জন্য প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু টিপু অনেক লোকজনের মধ্যে থাকায় গুলি করতে না পেরে টিপুর গাড়ি অনুসরণ করে সে। গাড়িটি শাহজাহানপুর রেল লাইনের আগে আমতলা সংলগ্ন রাস্তায় যানজটে আটকা পড়লে মাসুম গাড়ির চালকের পাশের আসনে বসা টিপুকে লক্ষ্য করে উপর্যুপরি গুলি করে। টিপুর মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায় সে।

জয়পুরহাট সীমান্ত দিয়ে পালানোর চেষ্টা

ঘটনার পর দুই বন্ধুর সহযোগিতায় নিরাপদ স্থানে আত্মগোপনে যায় শুটার মাসুম। পরে সে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে নিরপরাধ রিকশা আরোহী প্রীতি এবং টিপুর মৃত্যুর সংবাদ দেখতে পায়। এরপর সে জয়পুরহাট চলে যায়। সেখান থেকে সীমান্ত পার হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু পার হতে না পেরে বগুড়ায় যায় সে। সেখানে অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার পর বগুড়া জেলা পুলিশের সহযোগিতায় মাসুমকে গ্রেপ্তার করা হয়।

কারা মাসুমকে কন্ট্রাক্ট দিয়েছে— জানতে চাইলে হাফিজ আক্তার বলেন, যারা কন্ট্রাক্ট দিয়েছে তাদের কয়েকজনের নাম সে বলেছে। টাকা নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সুবিধা পাইয়ে দেওয়া, তার নামে মামলা তুলে নেওয়ার সুবিধার বিষয় থাকতে পারে।

ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, অনেকদিন পর শুটিং কিলিংয়ের ঘটনা ঘটেছে। আমরা দিনরাত পরিশ্রম করেছি। শুটিং মিশনে অনেকগুলো গুলি ছোড়া হয়। মূল কিলার গ্রেপ্তার হয়েছে। এখন তদন্তে জানা যাবে মোটিভ। আর কারা ছিল, কী কারণে খুন, পেছনে কারা জড়িত তা জানার চেষ্টা চলছে।

অস্ত্র উদ্ধার করা যায়নি। তাহলে কীসের ভিত্তিতে বলছেন মাসুমই টিপু হত্যার শুটার— এমন প্রশ্নের জবাবে হাফিজ আক্তার বলেন, তদন্তে নিশ্চিত হয়েছি, সে কিলিং মিশনে ছিল। ঘটনার পর ৫/৬ ঘণ্টার মধ্যেই নিশ্চিত হই, কিলিং মিশনে সেসহ দুজন ছিল। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি।

পালানোর সময় তার কর্মকাণ্ড, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ, মোটরসাইকেলের ব্যবহার- এসব মিলিয়ে আমরা নিশ্চিত হয়েই তাকে গ্রেপ্তার করেছি।

গত বৃহস্পতিবার (২৪ মার্চ) রাত ৯টা ৫০ মিনিটের দিকে জাহিদুল ইসলাম টিপু মাইক্রোবাসে করে শাহজাহানপুর আমতলা হয়ে বাসায় ফিরছিলেন। শাহজাহানপুর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের সামনে পৌঁছালে হেলমেট পরা দুর্বৃত্তরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। এতে জাহিদুল ও তার গাড়িচালক মুন্না গুলিবিদ্ধ হন। এ সময় জাহিদুলের গাড়ির পাশে রিকশায় থাকা বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্রী প্রীতিও গুলিবিদ্ধ হন। তাদের রক্তাক্ত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জাহিদুল ও প্রীতিকে মৃত ঘোষণা করেন। গুলিবিদ্ধ গাড়িচালক মুন্না বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

এ ঘটনায় পরের দিন শুক্রবার (২৫ মার্চ) দুপুরে নিহত জাহিদুল ইসলাম টিপুর স্ত্রী ফারজানা ইসলাম ডলি বাদী হয়ে শাহজাহানপুর থানায় অজ্ঞাতদের আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ১৮।

এজাহারে তিনি আরও বলেন, প্রতিদিনের মতো বৃহস্পতিবার মাইক্রোবাস নিয়ে গাড়িচালক মনির হোসেন মুন্নাসহ তিনি এজিবি কলোনির রেস্টুরেন্টে যান। রাতে বাসায় আসার পথে আনুমানিক সোয়া ১০টার দিকে শাহজাহানপুর মানামা ভবনস্থ বাটার দোকানের সামনে অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারীরা পূর্ব শত্রুতার জের ধরে আমার স্বামীকে এলোপাতাড়ি গুলি করে। গুলিতে গাড়ির গ্লাস ভেঙে যায় এবং আমার স্বামীর গলার ডান পাশে, বুকের বাম পাশে, বুকের বাম পাশের বগলের কাছাকাছি, পেটের মধ্যে নাভির নিচে, বাম কাঁধের ওপরে, পিঠের বাম পাশের মাঝামাঝি স্থানে, পিঠের বাম পাশের কোমর বরাবর, পিঠের ডান পাশের কোমরের ওপর মারাত্মক জখম হয়। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। দুষ্কৃতকারীরা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করার সময় প্রীতি নামে এক পথচারীও নিহত হন।

একই ঘটনায় রিকশায় থাকা যাত্রী বদরুন্নেসা কলজের ছাত্রী প্রীতি খুনের বিষয়ে মামলা করবেন না বলে জানিয়েছেন তার বাবা।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেয়ে হত্যার বিচার চাই না। মামলা চালানোর মতো অবস্থাও নেই। আমরা নিরীহ মানুষ। বিচার চাইলে আল্লাহ’র কাছে চাই। তিনিই বিচার করবেন।

প্রীতিদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগরে। সেখানে যাতায়াত কম। বাবার চাকরিসূত্রে ঢাকায় থাকেন তারা।

জেইউ/এসএসএইচ/জেএস