টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান

রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্লাটফর্মস ২০২১ শীর্ষক খসড়া নীতিমালাটি কার্যকর হলে গোপনীয়তা বলে কোনো কিছু থাকবে না। সাধারণ মানুষের সাংবিধানিক অধিকার বাক স্বাধীনতা খর্ব হবে। নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ সময়োপযোগী হলেও পরস্পর বিরোধী অবস্থান রয়েছে। যার অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।

রোববার (৩ এপ্রিল) রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্লাটফর্মস ২০২১ শীর্ষক খসড়া নীতিমালার ওপর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলা হয়। সংস্থাটির পরিচালক (আউটরিচ কমিউনিকেশন) শেখ মঞ্জুর ই আলম মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিটিআরসির এ ধরনের নীতিমালা সময়োপযোগী মনে করছি। তবে এর মধ্যে অনেক ঘাটতি রয়েছে। পরস্পর বিরোধী অবস্থান রয়েছে। যার অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।

তিনি বলেন, ডিজিটাল প্লাটফর্মের কারণে যেমন অগাধ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তেমনি এর অপব্যবহারও হচ্ছে, এটা বাস্তবতা। কাজেই এটা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সে দৃষ্টিকোণ থেকেই বিটিআরসি এটা করেছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এর সহায়ক ভূমিকাও থাকতে হবে। যাতে সেবা প্রদানকারীরা নির্বিঘ্নে সেবা দিতে পারে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা, পরস্পরের সঙ্গে বার্তা আদান-প্রদানের গোপনীয়তার সুরক্ষা দিতে হবে। অর্থাৎ ভারসাম্যপূর্ণ লক্ষ্য থাকা প্রয়োজন।

কিন্তু নতুন নীতিমালা কার্যকর হলে নির্বিঘ্নে সেবা পাওয়ার জায়গাটি থাকবে না। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের সাংবিধানিক অধিকার বাক স্বাধীনতা খর্ব হবে বলে মনে করি।

শেখ মঞ্জুর ই আলম বলেন, খসড়া নীতিমালায় প্লাটফর্ম নিয়ে যত বেশি না কথা বলছেন, তার চেয়ে বেশি কথা বলছেন কন্টেন্ট নিয়ে। অর্থাৎ কন্টেন্টের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন তারা। সন্ত্রাসবাদ ও শিশু পর্নোগ্রাফি ছাড়া যেকোনো কন্টেন্টের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা আন্তর্জাতিক আইন বিরোধী। কিন্তু এখানে অনেকগুলো টার্ম ব্যবহার করা হয়েছে, যার সুনির্দিষ্ট আইনগত সংজ্ঞা আমাদের জানা নেই। এটার যে অপব্যবহার হতে পারে, তার প্রমাণ দেখেছি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহারের ক্ষেত্রে। এ ধরনের অভিজ্ঞতার কারণে আমরা শঙ্কিত। কারণ নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে সরকারের কী উদ্দেশ্য কাজ করছে, সেটা পরিষ্কার নয়। সেটা কি রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক কিংবা না বোঝার বিষয় রয়েছে কিনা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মনে হয়েছে, যারা খসড়াটি প্রণয়ন করেছেন তারা মূল বিষয়টি ধরতেই পারেনি।

তিনি আরও বলেন, আমার কাছে হতাশার জায়গা যেটা মনে হচ্ছে- আমাদের সামনে এক ধরনের রেভুলেশন এসেছে। সেটা নিয়ে যতটুকু আলোচনা হওয়া দরকার সেটা হচ্ছে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা ও এ ধরনের নিবর্তনমূলক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োগ অযোগ্য ধারাগুলো চাপিয়ে দেওয়া হয়, তার পরিণতি খুব শুভকর হবে বলে মনে করছি না।

আজকে আমি যে মেসেজটা পাঠাচ্ছি একজনকে, সেটা দুজনের বাইরে কেউ পড়তে পারছে না। কিন্তু আমাদের এই খসড়া নীতিমালা যদি বাস্তবায়ন হয়, তাহলে আমাদের দেশের ওই প্রতিষ্ঠানগুলো আমার ও আপনার মধ্যে পাঠানো বার্তাগুলো পড়তে পারবে। আমার পরিচয় জানাতে পারবে। অর্থাৎ গোপনীয়তা বলে কোনো কিছু থাকবে না।

এ খসড়া নীতিমালার ৭.০৩ (ক) ধারায় বলা হয়েছে, বার্তা পরিষেবা প্রদানকারীকে আদালত বা বিটিআরসির নির্দেশে প্রত্যেক সেবাগ্রহণকারী বা ব্যবহারকারীকে যাতে শনাক্ত করা যায়, তার কার্যকর পদ্ধতি নিশ্চিত করতে হবে।

এ বিষয়ে টিআইবির মতামত, বর্তমানে বেশিরভাগ বার্তা পরিষেবা প্রদানকারী মাধ্যমসমূহ মূলত অ্যান্ড-টু-অ্যান্ড এনক্রিপশন পদ্ধতি  ব্যবহার করছে। কিন্তু ধারাটি বলবৎ হলে বার্তা পরিষেবা প্রদানকারীকে এই এনক্রিপশন ব্যবস্থা ভাঙতে হবে। যাতে জনসাধারণের মৌলিক অধিকার “ব্যক্তি গোপনীয়তা” সরাসরি লঙ্ঘিত হবে। বৈশ্বিক পর্যায়ে কেবলমাত্র সন্ত্রাসবাদ ও শিশু পর্নোগ্রাফি রোধে কর্তৃপক্ষের এ জাতীয় বিধি-নিষেধ আরোপের বিষয়টি স্বীকৃত। কিন্তু তা কোনোভাবেই বিরুদ্ধ মতামত, কর্তৃপক্ষের সমালোচনা বন্ধ বা বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির ওপর নজরদারি করার ক্ষেত্রে বৈধতা প্রদান করে না।

ধারাটি বলবৎ থাকলে অনেক ব্যবহারকারীই নিরাপত্তা ও হেনস্তার শিকার হওয়ার ভয়ে ব্যক্তিগত মেসেজিং পরিষেবাগুলোতে নিজেদের ভাব প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকবেন। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতার কারণে মেসেজিং সার্ভিসগুলো বাংলাদেশে তাদের সেবা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে।

টিআইবি আরও বেশকিছু ধারার বিষয়ে তার মতামত ব্যক্ত করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-

খসড়া নীতিমালার ধারা-১ এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে টিআইবি বলছে, খসড়া নীতিমালায় ‘ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা প্রদানকারী’, ‘সেবা’ অথবা ‘অ্যাপ্লিকেশন’ এর মতো শব্দগুলোর সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। ফলে এর প্রয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের মর্জির ওপর নির্ভর করতে হবে। এছাড়া বিদেশি মালিকানাধীন বা বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমানার বাইরে অবস্থানকারী সেবা প্রদানকারী সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বা সহযোগিতার ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু উল্লেখ নেই। অথচ নীতিমালার প্রয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে সমধর্মী বিদেশি প্লাটফর্ম, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্তির ইঙ্গিত রয়েছে। ফলশ্রুতিতে নীতিমালাটির এই অস্পষ্টতা ও সর্বব্যাপী ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনায় দেশের বাইরের সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করবে।

নীতিমালার ধারা ৪, ৫, ৬.০২ ও ৭.০২ এর বিষয়ে টিআইবি বলছে, আবেদন করার ক্ষেত্রে ‘কর প্রদানকারী শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন)’, ‘ট্রেড লাইসেন্স’ ও ‘মূল্য সংযোজন কর সনদ’ থাকার শর্ত দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, বিদেশে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধনের ক্ষেত্রে কোন ধরনের পদ্ধতি বা নীতি অনুসৃত হবে, তা স্পষ্ট করে বলা হয়নি।

খসড়া প্রণয়নকারীরা বুঝতেই পারেননি যে, ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা দেওয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমানার মধ্যে অবস্থানের বাধ্যবাধকতার কোনো যোগসূত্র নেই। বরং স্থানীয় অবকাঠামো, প্রশিক্ষিত জনবল ও তৃতীয় পক্ষের সহযোগিতা ছাড়াই বিদ্যমান টেলিকমিউনিকেশন কাঠামো ব্যবহার করে কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়া সম্ভব।

বিটিআরসিকে যেভাবে ‘নিবন্ধন সনদ’ বাতিল, স্থগিত ও প্রত্যাহারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তাতে দেশের বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোর দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসা পরিচালনা বাধাগ্রস্ত হবে। এমনকি অনেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে।

ধারা ৬.০১ এ বিষয়ে টিআইবির মতামত হচ্ছে- কন্টেন্ট অপসারণ সংক্রান্ত বিধানের ব্যাপক বিস্তৃত ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ। সাংবিধানিক অধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে, অনলাইন কন্টেন্টের নিয়ন্ত্রণ সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের অধীনে নিশ্চিত করা বাক ও মতপ্রকাশ এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপের শামিল। তাছাড়া নির্দেশিত কনটেন্ট অপসারণের জন্য যে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে, তা স্থানীয় মধ্যবর্তী প্রতিষ্ঠানগুলোকে জরিমানা ও শাস্তির এড়ানোর ভয়ে ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ আরোপের পাশাপাশি অনেক যৌক্তিক কনটেন্ট পরিবেশন থেকেও বিরত রাখতে পারে। যা নাগরিকদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনকে প্রকটতর করে তুলতে পারে। আর প্রতিটি কনটেন্ট অপসারণের অনুরোধ অবশ্যই যৌক্তিক হতে হবে। প্রসঙ্গত নিম্ন আদালতের রায়ের এমন অনেক নজির রয়েছে যার বিচারিক এবং প্রশাসনিক আদেশের যৌক্তিকতা উচ্চতর আদালত সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন।

আরএম/ওএফ