নাহিদা রহমান সুমনা। পেশাদার এ কূটনীতিক বর্তমানে ব্রুনাইয়ে বাংলাদেশের হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করছেন। ২৪ বছর আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন তিনি। পেশাগত দায়িত্ব পালনে দেশে-বিদেশে সমানতালে কাজ করতে হচ্ছে দুই সন্তানের এ জননীকে। দেশের হয়ে কাজ করতে গিয়ে আট বছর সন্তানদের কাছ থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে থাকছেন। দীর্ঘ সময় সন্তানদের পাশে থাকতে না পারা বা সব সময় কাছে না পাওয়ার যন্ত্রণায় মন পোড়ে এ কূটনীতিকের। তবে স্বামী-সন্তানদের সমর্থন ও অনুপ্রেরণা সুমনাকে সামনে চলার এবং দেশের জন্য ভালো কাজ করার পাথেয় যোগায়।

কূটনীতিক সুমনা ঢাকা পোস্টের মাধ্যমে একজন মা হিসেবে বিশ্ব মা দিবসে সব মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়েছেন। এছাড়া নিজের সন্তানদের পাশে না পাওয়ার আক্ষেপ, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজের মাকে সময় না দিতে পারা, স্বামীর সমর্থন ও কূটনীতিক জীবনের হালচাল নিয়ে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপ করেছেন তিনি।

সুমনা ২০২০ সালে ব্রুনেইয়ে বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে যোগ দেন। হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে ঢাকায় কনস্যুলার অনুবিভাগের মহাপরিচালক হিসেবে কাজ করেন। দায়িত্ব পালন করেছেন ব্রাজিলের বাংলাদেশ মিশনে চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সে। এছাড়া এ কূটনীতিক অটোয়া, কলকাতা ও ক্যানবেরা মিশনে বিভিন্ন পদে কাজ করেছেন।

কূটনীতিক হিসেবে অটোয়ায় দায়িত্ব পাওয়া সুমনা স্বামী-সন্তানদের নিয়ে একসঙ্গে থাকতেন। কিছুদিন পরিবার নিয়ে ভালোই চলছিল তার। কিন্তু ব্রাজিলে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মিজারুর কয়েস হঠাৎ মারা গেলে সরকার সুমনাকে মিশনে চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সের দায়িত্ব দেন। ২০১৪ সালে অটোয়ায় পরিবার রেখে তাকে ব্রাজিলে পাড়ি জমাতে হয়। সঙ্গে ১২ বছর বয়সী ছোট সন্তানকেও নেওয়ার সুযোগ হয়নি। সেই থেকে এখন পর্যন্ত স্বামী-সন্তাদের নিয়ে একসঙ্গে থাকার সুযোগ মেলেনি সুমনার।

পরিবারের সঙ্গে থাকতে না পারার আক্ষেপের কথা বলতে গিয়ে হাইকমিশনার সুমনা বলেন, আমার দুই সন্তান তাদের বাবার সঙ্গে কানাডাতে থাকছে। বড় সন্তান পড়ালেখা শেষ করে সেখানে চাকরি করছে। আর ছোট সন্তানের বয়স এখন ১৯ বছর। সে পড়ালেখা করছে। ব্রাজিল মিশনে দায়িত্ব পাওয়ার পর ছোট সন্তানসহ পুরো পরিবার রেখে চলে যেতে হয়। সেই থেকে সন্তানদের সঙ্গে থাকতে পারছি না। ওদের খুব মিস করি। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ওদের সঙ্গে থাকতে পারছি না।

ব্রাজিলে দায়িত্ব পালনকালে পরিবারের সঙ্গে থাকতে না পারলেও ছুটিতে সন্তানদের কাছে পেতেন এ কূটনীতিক। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে দেড় বছরের বেশি সময় সন্তানদের ছুঁয়ে দেখার সুযোগও হয়নি হাইকমিশনার সুমনার। তিনি বলেন, আমি যখন ব্রাজিলে চলে যাই, তখনও সন্তানদের কাছে পেতাম। ব্রুনাইয়ে দায়িত্বে যাওয়ার পর মন্ত্রণালয় থেকে তিন সপ্তাহের ছুটি পেলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে কানাডায় সন্তানদের কাছে যেতে পারিনি। করোনার কারণে ফ্লাইট ঠিক মতো মেলেনি। আবার ওখানে গেলে এক সপ্তাহের কোয়ারেন্টাইন করতে হতো।

ব্রুনাইয়ে হাইকমিশনারের দায়িত্ব পাওয়ার পর দূরত্বের কারণে সন্তানদের সঙ্গে দেখা করার আরও দুষ্কর হয়ে গেছে বলে জানান সুমনা। তিনি বলেন, ব্রুনাই থেকে কানাডার দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় দেখা হওয়ার সুযোগটা আরও কঠিন হয়ে গেল। কানাডা থেকে ব্রুনাইয়ে যাওয়া-আসা ঝামেলা। একে তো করোনা পরিস্থিতি। তাছাড়া কানাডা থেকে দুই সন্তান আর তাদের বাবার এখানে আসাও অনেক টাকার ব্যাপার। আমি যে সেখানে যাব, সেটা চাইলেও পারছি না। কারণ মন্ত্রণালয়ে থাকাকালে ছুটি পাওয়া যতটা সহজ, একজন দূত হিসেবে সেই ছুটি পাওয়ার প্রক্রিয়াটা বেশ জটিল।

সন্তানদের কাছ থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে থাকলেও প্রতিদিন এ কূটনীতিকের দিনের শুরুটা হয় সন্তানদের সঙ্গে কথার মাধ্যমে। রাতেও সন্তানদের সঙ্গে না কথা না বলে ঘুমতে যান না সুমনা। তিনি জানান, দিন শুরু করি ওদের সঙ্গে কথা বলে। তবে সময়ের পার্থক্যটা খুব ঝামেলা। আমার সকাল, ওদের সন্ধ্যা। ওদের সঙ্গে কথা না বলে সকালের নাশতা করতে পারি না। ওদের সঙ্গে কথা বলে অফিসে যাই। সন্ধ্যায় অফিস থেকে এসে বসে থাকি, কখন ওদের সকাল হবে। আমার এখানে যখন রাত, ওদের ওখানে সকাল। রাতেও ওদের সঙ্গে এক থেকে দুই মিনিট কথা বলে ঘুমাতে যাই। ছোট ছেলেটাকে অনেক সময় তার বাবা জোর করে কথা বলিয়ে দেয়।

সন্তানের স্পর্শ না পাওয়ার কষ্ট ভুলে থাকতে ব্রুনাইতে পিছিয়ে পড়া শিশুদের নিয়ে কাজ করেন হাইকমিশনার সুমনা। তিনি বলেন, সন্তানদের খুব মিস করি। ওদের মিস করি বলেই ব্রুনাইতে পিছিয়ে পড়া শিশুদের নিয়ে কাজ করি। অবসর সময় তাদের সঙ্গে কাটাই। এখানে রিডিং অ্যান্ড লিটারেলি অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে কাজ করি। এগুলো মন থেকে করি। ব্রাজিলেও শিশুদের ইংরেজি শেখাতাম। কানাডাতেও এ ধরনের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। ওই দেশগুলো থেকে আমাকে সম্মাননাও দেওয়া হয় এ কাজের জন্য।

কূটনীতিক হিসেবে আজকের এ অবস্থানের জন্য স্বামীর অবদানকেই সবার ওপরে রাখছেন সুমনা। তিনি বলেন, স্বামী উৎসাহ না দিলে কূটনীতিক হওয়া সম্ভব ছিল না। এখনও স্বামীর কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়ে যাচ্ছি। এখনও চাকরিটা করতে পারছি ওনার কারণে।

দেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই কূটনীতিকদের বেশিরভাগ সময় বিদেশেই কাটাতে হয়। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কিছু দিন পরপর এক দেশ থেকে চলে যেতে হয় অন্য দেশে। অনেক সময় পড়ালেখাসহ নানা কারণে পরিবারকে সঙ্গে নেওয়া সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে দেশের জন্য কূটনীতিকদের অনেক সময় নিজের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে হয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হাইকমিশনার সুমনা কিছু সময় নীরব থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তিনি বলেন, অনেকের মনে হতে পারে, কূটনীতিকরা বিদেশ ঘুরে। এখানে যায়, ওখানে যায়। কিন্তু বাস্তবতা যে কতটা কঠিন সেটা বলে বোঝানো যাবে না। সন্তানদের সঙ্গে থাকতে পারছি না, পরিবার থেকে দূরে। অনেক ক্ষেত্র দুই তিন বছর পরপর তাদের দেখা পাওয়ার সুযোগ হয়। বড় ছেলের গ্রাজুয়েশনের অনুষ্ঠানে যেতে পারিনি। আমাদের অনেক সেক্রিফাইজ করতে হয়। ছোট ছেলের গ্রাজুয়েশনে যেতে পারব কি না জানি না। তবে আমার ছেলেরা আমার এ লাইফের জন্য প্রশংসা করে। তারা বলে, মা তুমি অনেক স্ট্রং।

সুমনার পৈত্রিক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া হলেও তার জন্ম ময়মনসিংহে। গত বছরের অক্টোবরে মাকে হারান হাইকমিশনার সুমনা। দায়িত্বের কারণে মাকে সময় না দিতে পারার আক্ষেপ রয়ে গেছে তার। মায়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, আমার মা ওয়ার্কিং লেডি ছিলেন। সব সময় হাসিমুখে থাকতেন। সংস্কৃতিমনা মানুষটার মধ্যে কখনো অভিযোগ দেখিনি। বিদেশে চাকরির কারণে দুই-তিন বছর পর পর মায়ের সঙ্গে দেখা হতো। দায়িত্বের কারণে মাকে ওভাবে সময় দিতে পারিনি। মাকেও খুব মিস করি।

এনআই/এসএসএইচ