মিডিয়ার মাধ্যমে জানার পর থেকেই আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদারের (পি কে হালদার) বিষয়ে ভারতের সঙ্গে আনঅফিসিয়াল পর্যায়ে তথ্য বিনিময় হচ্ছে। বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে বলে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান মঈনউদ্দিন আবদুল্লাহ।

পি কে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে জানতে চাইলে রোববার (১৫ মে) ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ তথ্য জানিয়েছেন।

দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের দেশে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি ও আইন রয়েছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্দি বিনিময় চুক্তি রয়েছে। আমরা এখন মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারলাম। অফিসিয়ালভাবে জানতে হবে, জানার পরে যোগাযোগ করব। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জননিরাপত্তা বিভাগসহ সবাই মিলে এক সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে।

তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে আনঅফিসিয়াল যোগাযোগ রাখছি। কিছু তথ্য লেনদেন হচ্ছে। ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে আনঅফিসিয়ালি কিছু করা যায় না। মিডিয়ায় আসার পর আমরা তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করেছি। তবে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে এখনও অফিসিয়ালি কিছু শুরু করিনি। আমরা দেখি ভারত সরকারিভাবে কী জানায়?

ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেডএলার্ট জারি করা ছিল, এটি পিকে হালদারকে ফিরিয়ে আনতে বাড়তি কোনো সুবিধা দেবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের সঙ্গে ভারতের বন্দি বিনিময় চুক্তিই আছে। আনতে হলে চুক্তির আওতায় আনা হবে। ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেডএলার্ট ভারতসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও দেওয়া হয়েছে। রেড এলার্ট জারির পর ভারত সময়ে সময়ে বেশকিছু তথ্য চেয়েছিল। আমরাও দিয়েছি।

অন্যদিকে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম পিকে হালদার প্রসঙ্গে বলেন, ‘তদন্তাধীন মামলায় দুর্নীতি দমন কমিশন পি কে হালদারকে অবশ্যই রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। তখন দেখা যাবে এখানে আরও অনেক বড় রুই-কাতলা জড়িত রয়েছে। তাদেরও ধরা সহজ হবে তখন। সে কানাডা থেকে ভারতে চলে আসার বিষয়ে দুদকের কাছে কোনো তথ্য ছিল না। তবে তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্ট ছিল।

যেভাবে ফেরত আনা হতে পারে
কোনো বন্দিকে ফেরত আনার ব্যাপারে সরকার ‘আনুষ্ঠানিকভাবে যথাযথ মাধ্যমে’ সেই দেশের সরকারকে চিঠি দেয়। চিঠি পাওয়ার পর সেই দেশের সরকার বিবেচনা করবে। পরে বিনিময়ের মতো হলে তারা বন্দিকে ফেরত দেবে। পি কে হালদারের বিষয়ে অন্য কোনো জটিলতা না থাকলে আনুষ্ঠানিকতা শেষে তিন মাসের মধ্যে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

২০১৩ সালের অক্টোবরে ভারতের সঙ্গে বহিঃসমর্পণ চুক্তি করে বাংলাদেশ। এ চুক্তির আওতায় দুই দেশ বন্দি বিনিময় করার সুযোগ পাবে। এ চুক্তি হওয়ার আগে অনানুষ্ঠানিকভাবে সীমান্ত পার করিয়ে দুই দেশের মধ্যে বন্দি বিনিময় হতো।

বাংলাদেশের কারাগারে থাকা ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার নেতা অনুপ চেটিয়াকে ভারত চাওয়ার পর থেকে এই বন্দি বিনিময় বা বহিঃসমর্পণ চুক্তির বিষয়টি সামনে আসে। তবে সাধারণত বন্দি ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দেশ বন্দির বিরুদ্ধে আদালতের দেওয়া সাজা দেখতে চায়।

২০২১ সালের ৮ জানুয়ারি দুদকের অনুরোধে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দিয়ে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছিল।

২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে যখন ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের গ্রাহকরা অর্থ ফিরে পেতে অভিযোগ করতে থাকেন তখনই দুদকের অনুসন্ধান শুরু হয়। সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তার অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে পি কে হালদারের আর্থিক দুর্নীতির নানা তথ্য। একই সঙ্গে তার বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটও। আত্মসাতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ব্যাংক কর্মকর্তা ও নিজস্ব বাহিনীকে কাজে লাগিয়েছেন পিকে হালদার চক্র।

দুদকসহ বিভিন্ন সংস্থার তথ্যানুসারে পি কে হালদার ও তার সঙ্গীরা মিলে অন্তত ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। যা বিভিন্ন উপায়ে হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে পাচার করা হয়েছে। অনুসন্ধানের সময় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পি কে হালদারের লাগামহীন দুর্নীতির নথিপত্র সংগ্রহ করে দুদক।

এসব নথিতে দেখা যায়, এ ব্যক্তি অস্তিত্বহীন ৩০-৪০টি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ঋণের নামে জালিয়াতি করে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেড ও পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস থেকে আত্মসাৎ করেছেন প্রায় ১০ হাজার ২শ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে দুই হাজার ৫০০ কোটি, এফএএস ফাইন্যান্স থেকে প্রায় দুই হাজার ২০০ কোটি, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে প্রায় দুই হাজার ৫০০ কোটি ও পিপলস লিজিং থেকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এসব ঋণের বিপরীতে মর্টগেজ (জামানত) নেই বললেই চলে।

যেসব প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে ঋণ উত্তোলন
পি কে হালদার ও তার সহযোগীরা একের পর এক কাগুজে প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে ঋণ তুলতেন। পরে বিভিন্ন কৌশলে আত্মসাৎ ও পাচার করতেন।

দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্তে আসা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে—নিউটেক এন্টারপ্রাইজ, নিউট্রিক্যাল লিমিটেড, এস এ এন্টারপ্রাইজ, সুখাদা প্রপার্টিজ লিমিটেড, নেচার এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, উইনটেল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, বর্ণ, সন্দ্বীপ করপোরেশন, আনান কেমিক্যাল ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেড, অ্যান্ডবি ট্রেডিং, আরবি এন্টারপ্রাইজ, দেয়া শিপিং লিমিটেড, ইমার এন্টারপ্রাইজ, জি অ্যান্ড জি এন্টারপ্রাইজ, হাল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, কণিকা এন্টারপ্রাইজ, মেরিনট্রাস্ট লিমিটেড, মুন এন্টারপ্রাইজ, এমটিবি মেরিন লিমিটেড, ও পি অ্যান্ড এল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড। এ ছাড়াও আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ তুলে তা আত্মসাৎ করেন পি কে হালদার।

দুদকের যত মামলা
আলোচিত পিকে হালদার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরুর চার মাস পর প্রথম মামলা করে দুদক। ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেন সংস্থাটির উপপরিচালক মো. সালাউদ্দিন। পরবর্তী সময়ে দুদকের আরেক উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বে একটি টিম আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। ওই টিম বিগত দুই বছরে অন্তত ৩৪টি মামলা করে। এছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলার চার্জশিট ২০২১ সালের নভেম্বরে দাখিল করা হয়। যেখানে ৪২৬ কোটি টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৬ হাজার ৮০ কোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক এমডি পিকে হালদারসহ মোট ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় দুদক।

অন্যদিকে ৩৪ মামলার মধ্যে তিনটির তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। বাকিগুলো তদন্তাধীন। এসব মামলার তদন্তকালে এখন পর্যন্ত ১২ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে উজ্জ্বল কুমার নন্দী, পিকে হালদারের সহযোগী শংখ বেপারী, রাশেদুল হক, অবান্তিকা বড়াল ও নাহিদা রুনাইসহ ১০ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ ছাড়া এক হাজার কোটি টাকা সমমূল্যের সম্পদ অবরুদ্ধ ও জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে আদালতের মাধ্যমে ৬৪ জনের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। একই  ইস্যুতে ৩৩ ব্যক্তির সম্পদ বিবরণীর নোটিশ জারি করা হয়েছে। এর মধ্যে দুজন সময়মত জমা না দেওয়ায় তাদের বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়।

শনিবার (১৪ মে) ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার অশোক নগরের একটি বাড়ি থেকে পি কে হালদার ও তার পাঁচ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাকে আদালতে হাজির করলে তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন বিচারক।

এক বিবৃতিতে ইডি বলেছে, হাজার কোটি টাকা পাচারকারী পি কে হালদার নাম পাল্টে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশে বসবাস করতেন। প্রদেশের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার অশোক নগরের একটি বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন তিনি। বাংলাদেশি নাগরিক প্রশান্ত কুমার হালদার, প্রীতিশ কুমার হালদার, প্রাণেশ কুমার হালদার এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। প্রশান্ত কুমার হালদার নিজেকে শিব শঙ্কর হালদার নামে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতেন।

বাংলাদেশি এই অর্থপাচারকারী পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য থেকে ভারতীয় রেশন কার্ড, ভারতীয় ভোটার আইডি কার্ড, প্যান এবং আধার কার্ডও সংগ্রহ করেছিলেন। প্রশান্ত কুমার হালদারের অন্য সহযোগীরাও ভারতীয় এসব কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে সংগ্রহ করেন।

এর আগে, গত শুক্রবার দিনভর কলকাতা ও উত্তর চব্বিশ পরগনার অন্তত ৯ স্থানে অভিযান চালায় ইডি। সেসময় উত্তর চব্বিশ পরগনার অশোকনগর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার পোলেরহাটে দুটি বাড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় পি কে হালদারের ব্যক্তিগত আইনজীবী সুকুমার মৃধার অবৈধ সম্পত্তির খোঁজে অভিযান শুরু করে ভারতের এ সংস্থা। কর্মকর্তারা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে এই তল্লাশি অভিযান পরিচালনা করেন। এ সময় তাদের সঙ্গে প্রচুর নিরাপত্তাকর্মী ছিলেন।

শনিবার পি কে হালদারের সম্পত্তির খোঁজে দ্বিতীয় দফায় আবারও অভিযান শুরু করে দেশটির আইন শৃঙ্খলাবাহিনী। পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানীখ্যাত মুম্বাই এবং রাজধানী দিল্লিতেও অভিযান চালায় ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী এ সংস্থা।

আরএম/এসএম