খনন ও শাসন না করায় শাহ আমানত সেতুর নিচ থেকে থেকে চাক্তাই খালের মোহনা পর্যন্ত তিন কিলোমিটার চর জেগে সংকীর্ণ হয়ে গেছে কর্ণফুলী। সংকীর্ণ হওয়ায় স্রোতে শাহ আমানত সেতুর ৪ ও ৫ নম্বর পিলারের নিচের মাটিতে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। বড় জলোচ্ছ্বাস বা অতি বর্ষণে পানির স্রোতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সেতু, ধসে যেতে পারে সেতুর দক্ষিণ পাশের গাইড ওয়াল।

মার্চ-এপ্রিল দুমাস কর্ণফুলী নদীতে জরিপ চালিয়ে চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন রোববার (২২ মে) চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে ‘কর্ণফুলী নদীর তলদেশের গভীরতা ও দখল জরিপ ২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান।

প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, শাহ আমানত ব্রিজের উত্তর পাশে ১ ও ২ নম্বর পিলারের মাঝখানে গভীরতা ফিরিঙ্গি বাজার এলাকার পরিমাপ অনুযায়ী থাকার কথা ২৫ ফুট। সেখানে বর্তমান গভীরতা হচ্ছে মাত্র ৭ দশমিক ৭ ফুট।  ২ ও ৩ নম্বর পিলারের মাঝখানে গভীরতা থাকার কথা ৩৮ ফুট। বাস্তবে সেখানে চর জেগে উঠেছে। সেখানকার চরে জেলেদের মাছ ধরতে দেখা গেছে।

সেতুর ৩ ও ৪ নম্বর পিলার এলাকায় স্বাভাবিক গভীরতা থাকার কথা ৩৮ ফুট। সেখানে বর্তমান গভীরতা ৬৪ দশমিক ৭ ফুট। ৪ ও ৫ নম্বর পিলার এলাকায় (দক্ষিণ তীরের পাশে) নদীর স্বাভাবিক গভীরতা থাকার কথা ২৮ ফুট (চর পাথরঘাটা এলাকার মাপ অনুযায়ী)। কিন্তু ৪ নম্বর পিলারের পাশে গভীরতে ৭৮ দশমিক ৬ ফুট, যা কর্ণফুলী নদীর ফিরিঙ্গি বাজার থেকে শিকলবাহা খালের মুখ প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকায় সবচেয়ে গভীরতম স্থান।

ফ্যাদোমিটার দিয়ে পরিচালিত সার্ভেতে এ স্থানে পিলারের পাশে নদীর তলদেশের মাটিতে ছোট-বড় অনেক ফাটল দেখা গেছে, যা শাহ আমানত সেতুর জন্য উদ্বেগজনক। ব্রিজের দক্ষিণ পাশে তীরের কাছাকাছি নদীর তলদেশে গভীরতা বেড়ে যাওয়ায় তীরের মাটি সরে ব্রিজ ধসে যেতে পারে।

প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বন্দর কর্তৃপক্ষ ৩২১ কোটি টাকার ড্রেজিং প্রকল্প বাস্তবায়নের পর এ এলাকায় তিন বর্গকিলোমিটার চর জেগে উঠেছে। বর্তমানে চাক্তাই ও রাজাখালী খালের মুখ দখল করে ভেড়া ও মাছ বাজার গড়ে উঠায় ভয়াবহ ধ্বংসের কবলে পড়েছে কর্ণফুলী। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নদী লিজ দিয়ে মাছ মাজার গড়ে তোলায় অন্যান্য স্থাপনা উচ্ছেদে বিলম্ব হচ্ছে।

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আলিউর রহমান লিখিত বক্তব্যে নদীর বিভিন্ন স্থানের গভীরতা ও প্রশস্ততা তুলে ধরেন। তাতে দেখা যায়, ২০০০ সালে কর্ণফুলী সেতুর কাছে নদীর প্রস্থ ছিল ৯৩০ মিটার, তা বর্তমানে রয়েছে ৪১০ মিটার। ফ্যাদোমিটারের মাধ্যমে ভাটার সময় নদীর গভীরতা পরিমাপ করা হয়। তাতে চর পাথরঘাটা ব্রিজঘাট থেকে উত্তর পাশে গভীরতা পাওয়া যায় ২৫ ফুট। চাক্তাই খালের মোহনায় নদীর গভীরতা মিলেছে মাত্র দুই ফুট।

প্রতিবেদনে কর্ণফুলী রক্ষায় ছয়টি সুপারিশের কথা বলা হয়। সুপারিশগুলো হলো—

১. ২০২০ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হুসেন প্রদত্ত  উচ্ছেদ নোটিশ (৪৭/২০১৯) অনুযায়ী হাইকোর্টের নির্দেশ মতো চাক্তাই খালের মোহনায় গড়ে ওঠা মাছ বাজারসহ ৪৭ ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের অধীনে থাকা ১৮ শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ।

২. কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুর নিচ থেকে চাক্তাই খালের মোহনা পর্যন্ত তিন কিলোমিটার ব্যাপী জেগে উঠা চর খনন করে নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ ফিরিয়ে আনা।

৩. শাহ আমানত সেতুর তিন ও চার নম্বর পিলারের নিচে সৃষ্ট গর্তে বোল্ডার ঢেলে মাটি ক্ষয় রোধ করা।

৪. সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রণীত স্ট্রেটেজিক মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী নদীর সীমানা নির্ধারণ করে মেরিনার্স পার্ক, মাছ, বাজার ও ভেড়া মার্কেট এলাকার সকল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে খনন করা।

৫. সঠিক খনন ও শাসনের মাধ্যমে কর্ণফুলীর স্বাভাবিক গতিধারা বজায় রাখা।

৬. চাক্তাই ও রাজাখালের মোহনা অবমুক্ত করতে বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার নামে দখলে নেয়া অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা।

সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন কর্ণফুলী বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড.ইদ্রিস আলী, মেরিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নোমান আহমেদ সিদ্দিকি, বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরাম চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক প্রদীপ কুমার দাশ, অধ্যক্ষ জনার্দন বণিক, অ্যাডভোকেট সেলিম চৌধুরী, কর্ণফুলী নদী সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতির সভাপতি এস এম পেয়ার আলী ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাফর আহমেদ।

কেএম/আরএইচ