এ অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ৪১ জন নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছে কর্তৃপক্ষ।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের তিনদিন পর কর্তৃপক্ষ একটি বিবৃতি দিয়েছে। এতে তারা ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি কিছু বিষয়ে অভিযোগও তোলা হয়েছে। দেওয়া হয়েছে রহস্যের ইঙ্গিতও। 

সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকার এই বিএম কনটেইনার ডিপোটি স্মার্ট গ্রুপের মালিকানাধীন। ডিপোটি তৈরি করা হয় পোশাক ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যসহ বিভিন্ন আমদানি ও রপ্তানির কনটেইনার খালাস ও পরিবহনের জন্য। 

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় গণমাধ্যমে যে বিবৃতিটি এসেছে তাতে স্বাক্ষর রয়েছে স্মার্ট গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকীর। এতে বলা হয়েছে, কোনো মালিক কি চায় তার প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হোক? কোটি কোটি টাকা খরচ করে, হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে তৈরি করা সে ধরনের প্রতিষ্ঠান রক্ষায় মালিকেরই সবচেয়ে বেশি আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকে। এখন একতরফাভাবে কেউ যদি এ ধরনের দুর্ঘটনার জন্য কেবল মালিককেই দোষারোপ করেন, নানা অজুহাত খুঁজে একটি কোম্পানিকে ধ্বংস করতে চান তবে সেটা দুঃখজনক এবং সমগ্র ব্যবসায়ী সমাজের জন্য বড় অশনি সংকেত।

শনিবার রাতের এই অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। অনেকের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। পরিচয় শনাক্তে নিখোঁজদের স্বজনের নমুনা সংগ্রহ শুরু হয়েছে গতকাল থেকে। 

নিহতদের বাবা-মা, ভাই-বোন বা ছেলে-মেয়ের যেকোনো দুই জনের নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এ দুর্ঘটনায় আমরা ব্যথিত ও মর্মাহত। সেই সাথে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। আপনারা জানেন, কনটেইনার ডিপোর মূল কাজ হলো দৈনিক ভিত্তিতে কনটেইনারের জন্য জায়গা ভাড়া দেওয়া এবং তা আদায় করা। এখানে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের একটি অফিস আছে। তারা ডিপোতে আমদানি-রপ্তানি কাজে সার্বক্ষণিক তদারকি করেন। তাদের অনুমতি ব্যতীত কনটেইনার তো দূরের কথা এক কেজি পণ্যও ডিপোতে প্রবেশ কিংবা বের করা অসম্ভব। এমনকি যেকোনো কনটেইনার লক-আনলক করতেও তাদের অনুমতি প্রয়োজন হয়। ডিপোতে হাজার হাজার কনটেইনারের মধ্যে মাত্র একটি কনটেইনার বিস্ফোরণ হওয়া রহস্যজনক। ডিপো কর্তৃপক্ষ এ ঘটনার একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত চায়।’

এই ডিপোর আগুন এত বিধ্বংসী হওয়ার জন্য হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডকে দায়ী করা হচ্ছে। পোশাক ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যসহ বিভিন্ন আমদানি ও রপ্তানির কনটেইনার খালাস ও পরিবহনের জন্য নির্মিত ডিপোতে রাসায়নিক মজুদ বা সংরক্ষণ করা হবে কেন তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। 

এ প্রসঙ্গে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, হাইড্রোজেন পার অক্সসাইড আমদানি-রপ্তানি পণ্য। দেশের ৬টি কোম্পানি এটি উৎপাদন করে। স্বাভাবিকভাবে অন্যান্য পণ্যের মতো এটিও ডিপোতে শুল্কায়ন শেষে বন্দরের মাধ্যমে রপ্তানি হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আমাদের ডিপোর মাধ্যমেও পণ্যটি রপ্তানি হয়ে আসছে।

উদ্ধার কার্যক্রম তদারকি করেন ডিপো মালিক
বিবৃতিতে বলা হয়, দুর্ঘটনার সাথে সাথে পাশ্ববর্তী ফিলিং স্টেশনে রাতযাপন করে আগুন নির্বাপন এবং উদ্ধার কার্যক্রম তদারকি করেন স্বয়ং ডিপো মালিক। সেখান থেকে দ্রুত ২০টি অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে আহতদের ঘটনাস্থল থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এরপর থেকে চিকিৎসকদের চাহিদা মতো সার্বক্ষণিক বিনামূল্যে নির্দিষ্ট চারটি দোকান থেকে ওষুধপত্রসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসামগ্রী সরবরাহ করা হচ্ছে। পাশাপাশি কোম্পানির কন্ট্রোল রুমের মনিটরিং টিম তাদের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। আর রোগী ও তাদের আত্মীয় স্বজনদের আর্থিক সহায়তাসহ প্রয়োজনীয় থাকা-খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। 

বিবৃতিতে এমন দাবি করা হলেও রোববার সকালে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে মালিকপক্ষের কাউকে পাচ্ছি না। মালিকদের কাউকে পেলে আমরা জানতে পারতাম কোন কনটেইনারে কী আছে। এটা আমাদের জানা নেই। এজন্য উদ্ধার কাজে বেগ পেতে হচ্ছে। 

সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকার বিএম কনটেইনার ডিপোটি স্মার্ট গ্রুপের মালিকানাধীন। 

স্মার্ট গ্রুপের গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুজিবুর রহমান। তিনি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ বলে জানা গেছে। আজ মঙ্গলবার ঢাকাতে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কারো গাফিলতি পাওয়া গেলে সে যে দলেরই হোক না কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

অন্যদিকে এই দুর্ঘটনার জন্য সরকারকে দায় নিয়ে পদত্যাগ করা উচিত বলে মনে করছে বিএনপি। মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে গতকাল বিক্ষোভ করেছে ছাত্র অধিকার পরিষদ

ডিপো কর্তৃপক্ষ বিবৃতিতে আরও বলছে ‘মানবিক দিক বিবেচনায় নিহত প্রত্যেক পরিবারকে নগদ ১০ লাখ টাকা, অঙ্গহানির শিকার প্রত্যেককে ৬ লাখ টাকা এবং অপরাপর আহতদের ৪ লাখ টাকা করে সহায়তার ঘোষণা দেওয়া হয়। এছাড়া ফায়ার সার্ভিসের নিহত বীর সন্তানদের পরিবারকে নগদ ১৫ লাখ টাকা ও আহতদের ৭ লাখ টাকা করে প্রদানের ঘোষণা দিয়েছি। পাশাপাশি ঘটনার প্রকৃত সত্য উদঘাটনের জন্য বিএম কনটেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ ৫ সদস্যের আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।’

বিএম ডিপো মালিকপক্ষ আরও বলছে, এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহত পরিবারের শিশু থাকলে তারা প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত তার পরিবারকে প্রতি মাসে বেতনের সমপরিমাণ টাকা প্রদান এবং উপার্জনক্ষম সদস্য থাকলে চাকরির ব্যবস্থা করার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।

সরকার কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটিগুলোকে পূর্ণ সহায়তা করার কথাও বলা হয়েছে বিবৃতিতে।  

সর্বশেষ অবস্থা 
শনিবার রাতে শুরু হওয়া এ অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ৪১ জন নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছে কর্তৃপক্ষ। তাদের মধ্যে ৯ জন দমকল বাহিনীর কর্মী রয়েছে। এদকে ধ্বংসস্তূপ থেকে আরও দুটো দেহাবশেষ পাওয়া গেছে আজ। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা ৪৩ হওয়ার কথা। তবে এ  বিষয়ে এখনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি। 

এদিকে ওই কনটেইনার ডিপোর আগুন এখন প্রায় নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনী। 

৬৩ জনের চোখে আঘাত, ৬ জনকে ঢাকায় পাঠাতে হবে
চট্টগ্রাম মেডিকেলে কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৬৩ জন রোগী কোনো না কোনোভাবে চোখে আঘাত পেয়েছেন। তাদের মধ্যে ছয় জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে নেওয়া দরকার বলে জানিয়েছেন ন্যাশনাল আই কেয়ারের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক দীন মোহাম্মদ নুরুল হক।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে থাকা রোগীদের দেখে ন্যাশনাল আই কেয়ারের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক দীন মোহাম্মদ নুরুল হক।

 

মঙ্গলবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান তিনি। এর আগে তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে থাকা রোগীদের দেখেন। 

তিনি বলেন, আহত রোগীদের মধ্যে চমেকে ভর্তি ৬৩ জন রোগী চোখে কোনো না কোনোভাবে আঘাত পেয়েছেন। তবে সে আঘাতের মাত্রার পরিমাণে কম-বেশি আছে। কিছু কিছু আছে সিরিয়াস ইনজুরড। তাদের মধ্যে কারও শুধু চোখেই আঘাত। আবার কারও কারও শরীরের অন্য অঙ্গগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আহতদের মধ্যে ছয় জনের চোখের অবস্থা খুবই খারাপ। তাদের মধ্যে একজনের চোখের কর্নিয়া ফেটে গেছে। তাকে প্রয়োজনে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নিতে হতে পারে। আমরা চাই গুরুতর আহত ছয় রোগীকে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে। এছাড়া আরও পাঁচ-ছয় জন রোগীর চোখের অবস্থা খারাপ। কিন্তু তাদের শরীরের অন্যান্য অঙ্গের অবস্থা খুবই খারাপ। ফলে এখনই তাদের ঢাকায় নেওয়া সম্ভব নয়।

কেএম/এনএফ