আর স্বপ্ন দেখা নয়, এবার কাছে গিয়ে সেতু ছুঁয়ে দেখবে মানুষ। আগামী ২৫ জুন সেই স্বপ্ন ছোয়াঁর আকাঙ্ক্ষিত দিন। এ নিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। এর মধ্যেও কিছু মুখে হাসি নেই পদ্মার পাড়ে। কর্মসংস্থান হারানো আর রুটি-রুজির চিন্তায় পড়েছেন তারা।

এতদিন পদ্মা পারাপারে নিয়োজিত থাকা লঞ্চ ও ট্রলারের মালিক-শ্রমিকরা পড়েছেন এই দুশ্চিন্তায়। তাদের অনেকের মনে প্রশ্ন- সেতু চালু হলে নদীতে স্পিডবোট, লঞ্চ কিংবা ফেরির মতো নৌ-যান চলবে কি? বিদ্যমান ঘাটগুলো থাকবে তো?

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদ্মা নদীতে বিভিন্ন রুটে প্রতিদিন চলাচল করছে ৮৭টি লঞ্চ, দেড় শতাধিক স্পিডবোট, ১০টি ফেরি।

সেতু চালু হওয়ার পর ঘাটে মানুষের আনাগোনা কমে আসবে। বিভিন্ন সূত্রে শ্রমিকদের কানে খবর যাচ্ছে সেতু চালু হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে ঘাট বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ অবস্থায় নদী পারাপারের কাজে জড়িত এসব শ্রমিকদের রুটি-রুজির সংস্থানের দুশ্চিন্তা তাড়া করে বেড়াচ্ছে।

‘ঘাট ছাড়া আমাদের রুটি-রুজির ব্যবস্থা নেই’

ফেরি ঘাটে কথা হয় শ্রমিক রমজান আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, এখন যে পরিমাণ লোক ঘাট দিয়ে যাতায়াত করে, সেতু চালু হলে চার ভাগের তিনভাগ কমে যাবে। আবার বিভিন্ন দিক থেকে শোনা যাচ্ছে ধীরে ধীরে ঘাট নাকি বন্ধ হয়ে যাবে। তাহলে আমাদের কী হবে? ঘাটে লোকজন না আসলে তো আমাদের উপার্জন বন্ধ হয়ে যাবে।

রমজান আলী বলেন, পদ্মা সেতু হচ্ছে, এতে আমরা অনেক খুশি। তবে ঘাট যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে আমরা খাব কী? এরকম যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাহলে সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ থাকবে যেন আমাদের জন্য একটি বিকল্প ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। তাছাড়া আমাদের আর কোনো আয়ের ব্যবস্থা নেই।

তিনি আরও বলেন, আমরা অনেক অসহায়। ঘাট থাকলেও যে টাকা বেতন পাই, চলতে আমাদের কষ্ট হয়। আর যদি ঘাটই বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে তো আমাদের কোনো কর্মই থাকবে না।

লঞ্চ ঘাট সুপারভাইজার মো. আবু জাফর বলেন, ব্রিজ চালু হওয়ার পর যদি ঘাট বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে আমরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবো। আর যদি এই জায়গাটিকে একটি টুরিস্ট স্পট হিসেবে চালু রাখা হয়, বিভিন্ন জায়গা থেকে টুরিস্টরা যদি পদ্মা সেতু দেখতে এখানে ঘুরতে আসে, তাহলে আমাদের কিছু রুটিরুজির ব্যবস্থা হবে।

সেতু চালু হওয়ার পর ঘাটে মানুষের আনাগোনা কমে আসবে। বিভিন্ন সূত্রে শ্রমিকদের কানে খবর যাচ্ছে সেতু চালু হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে ঘাট বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ অবস্থায় নদী পারাপারের কাজে জড়িত এসব শ্রমিকদের রুটি-রুজির সংস্থানের দুশ্চিন্তা তাড়া করে বেড়াচ্ছে

তিনি বলেন, এই ঘাটে অন্তত একশর মতো ট্রলার আছে। এর সঙ্গে জড়িত কম হলেও চার থেকে পাঁচ হাজার মানুষ। এর বাইরেও পর্যটনকে কেন্দ্র করে অনেক দোকানপাটও আছে। সবমিলিয়ে অসংখ্য মানুষ আর তাদের পরিবার এই ঘাটের সাথে সরাসরি জড়িত। যদি এই ঘাটটি না থাকে, তাহলে দিন আনে দিন খায় এমন অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যখন তারা বেকার হয়ে যাবে, তখন এলাকায় চুরি-ছিনতাই বেড়ে যাবে। ঘাট না থাকলে এই জায়গাটি মাদকের আখড়ায় পরিণত হবে।

পর্যটন কেন্দ্র চালুর দাবি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, যদি ঘাটটি চালু রাখা হয় বা অন্তত একটি টুরিস্ট স্পট চালু করা হয়, তাহলে লঞ্চ-বোটের সাথে জড়িত বিশাল সংখ্যক এই মানুষগুলো খেয়েপরে বাঁচতে পারবে। এজন্য আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদয় দৃষ্টি কামনা করছি।

আলাদা পর্যটন কেন্দ্র করে দেওয়ার দাবি লঞ্চ মালিকদের

সেতু চালু হওয়ায় ঘাট বন্ধ হলে পথে বসতে হবে দাবি করে লঞ্চ মালিকরা বলছেন, সেতু চালু হলে ঘাটেরও গুরুত্ব হারিয়ে যাবে। কেউ আর এই পথে আসবে না সচরাচর। যদি ঘাট বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে আমাদের পথে বসতে হবে।

এ বিষয়ে লঞ্চ মালিক মো. আলম বয়াতি বলেন, মাওয়া-শিমুলিয়া ঘাটে আমার তিনটি ট্রলার আছে। আমি নিজে ট্রলার চালাই। প্রতিটি ট্রলারে দুইজন করে স্টাফ আছে। ঘাট যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে শুধু আমি এবং আমার পরিবার সমস্যায় পড়ব না, ৭টি পরিবারের ২৫ থেকে ৩০ জন মানুষের তিনবেলা খাবার জুটবে কি না কোন নিশ্চয়তা নাই।

তিনি বলেন, এই ঘাটটিতে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রচুর মানুষ ঘুরতে আসে। ঘাট যদি পর্যায়ক্রমে বন্ধও করে দেওয়া হয়, আমাদের অনুরোধ অন্তত এই জায়টিতে একটা পর্যটন কেন্দ্র করে দেওয়া হোক। তাহলে আমরা সুন্দরভাবে খেয়েপরে বাঁচতে পারব। এই এলাকায় মানুষ আসলেই আমাদের কাজকর্ম সব ঠিক থাকবে।

ঘাট নিয়ে মাথাব্যথা নেই বিআইডব্লিউটিসির

সেতু চালু হলে ঘাট বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না বা বন্ধ হলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) কর্তৃপক্ষের করণীয় প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এক কর্মকর্তা জানান, ঘাট নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।

তিনি বলেন, ঘাট বন্ধ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমাদের কাছে কোন নির্দেশনা আসেনি। একেক সময় একেক কথা শুনি। কেউ বলছে ঘাট বন্ধ হচ্ছে, আবার কেউ বলছে চালু থাকছে। আমাদের কাছে যখন নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আসবে, তখন এই ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাতে পারব।

যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্পেই কিছু মানুষ ভুক্তভোগী হয়: জাজিরার ইউএনও

শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল হাসান সোহেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন হবে। এই সেতু চালু হলে আমাদের এই অঞ্চলের পুরো চিত্রই পাল্টে যাবে। অর্থনৈতিক ভিত আরও মজবুত হবে। আপনারা জানেন, যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্পেরই অনেকগুলো সুবিধার পাশাপাশি কিছু অসুবিধা থাকে। বৃহত্তর স্বার্থে এটা আমাদের মেনে নিতে হবে। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র যে লঞ্চ-স্টিমার আর ঘাট শ্রমিকদের সমস্যা হবে তা নয়, ঘাট সংশ্লিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মিষ্টির দোকান, খাবারের দোকানসহ সবার কিছু না কিছু সমস্যা হবে। ঘাট বন্ধ হয়ে গেলে শ্রমিকদের পুনর্বাসনের কোনো পরিকল্পনা আপাতত সরকারের নেই।

মাঝির ঘাটটি সচল রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাদের তো এখন রেললাইন চলবে না, এর কাজ শেষ হতে আরও সময় লাগবে। তাই আপাতত ভারী কোনো পরিবহন পদ্মাসেতুতে অ্যালাউ করবে না। সুতরাং ভারী পরিবহনের জন্য আমাদের মাঝির ঘাটটি চালু রাখতে হবে। এমনকি ভবিষ্যতেও আমার মনে হয় ভারী পরিবহন সেতু দিয়ে চলতে দেওয়া ঠিক হবে না। সেক্ষত্রে একটি ফেরি ঘাট আমাদের চালু রাখা লাগবেই।

সেতু হওয়া মানেই নৌপথ বন্ধ হয়ে যাওয়া নয়: নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী

পদ্মা সেতু চালু হলে ঘাট বন্ধ হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আপাতত সেতু-ঘাট দুটোই সচল থাকবে। তাছাড়া সেতু চালু হওয়া মানেই যে নৌপথ বন্ধ হয়ে যাবে তা নয়। নৌ পথেরও প্রয়োজনীয়তা আছে।

তিনি বলেন, সেতু চালু হলে হয়তো প্রথম দিকে সব মানুষ সেতুর ওপর দিয়েই চলাচল করবে। কিন্তু কিছুদিন পর ফেরির ঘাটেও মানুষ আসবে। আমি মনে করি এখানে ঘাটেরও প্রয়োজনীয়তা আছে, ফেরি বা অন্যান্য নৌযানেরও প্রয়োজন আছে।

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, কাঁঠালবাগান ঘাটের মতো মাঝিকান্দি এবং শিমুলিয়া থেকে নদী পারাপারে সেতু ক্রস করতে হবে না। তাই ঘাটে ফেরি, লঞ্চ বা স্পিডবোর্ড চলাচলে কোন সমস্যা হবে না। যতদিন মানুষের চাহিদা থাকবে, আশা করি ঘাটও চালু থাকবে।

প্রসঙ্গত, আগামী ২৫ জুন উদ্বোধন হতে যাচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এই সেতু চালু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার লাখ লাখ মানুষের যাতায়াতের নতুন দিগন্ত উন্মোচন হবে। দূর হবে বহু যুগের ভোগান্তি।

টিআই/জেএস