‘গরিবের কোনো ভয় নাই, যদি ভয় থাকত তাহলে কি পাহাড়ে থাকতাম? আমাদের টাকা নাই, সম্পদ নাই বলেই জীবনের ঝুঁকি জেনেও পাহাড়ে থাকি। আজ যদি জায়গা-জমি থাকত তাহলে পাহাড়ের মধ্যে ঝুঁকিতে বসবাস করতাম না।’

পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস প্রসঙ্গে বলছিলেন হাসি বেগম নামে এক নারী। তার ঘরের কাছেই আরেকটি ঘরে পাহাড়ধসে মারা যান দুই বোন। শুক্রবার মধ্যরাতে চট্টগ্রামের আকবর শাহ ১ নং ঝিলের বরিশাল ঘোনা এলাকায় ওই পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে।

হাসি বেগমের বাড়ি বরিশালের রাজাপুর থানার জগন্নাথপুর এলাকায়। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, কয়েক বছর আগে স্বামী মারা গেছেন। গ্রামের বাড়িতে তার জায়গা-জমি নেই। তাই এই পাহাড়ের পাদদেশে রেলওয়ের জায়গা দখল করে ঘর তৈরি করে মেয়েদের নিয়ে বসবাস করছেন।  

তিনি বলেন, গরিব না হলে নিজের জীবন দিতে এখানে আসতাম না। টাকা থাকলে ভালো জায়গায় থাকতাম। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার মাইকিং করা হয়েছে, পাহাড় ছেড়ে যেতে বলেছে। আমরা যাইনি। আল্লাহ যদি এখানে মৃত্যু রাখে তাহলে এখানেই মৃত্যু হবে- বলেন হাসি বেগম। 

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবেই চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাহাড়ে বসবাস করছেন নিম্নআয়ের অনেক মানুষ। আর প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে চট্টগ্রামে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। দীর্ঘ হয় মৃত্যুর মিছিল। কিন্তু পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস বন্ধ হয় না। গত ১৪ বছরে পাহাড়ধসে দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। 

শনিবার চট্টগ্রামের আকবর শাহ ১ নং ঝিলের বরিশাল ঘোনা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে সেখানকার প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ আছে। পাহাড় কেটে নতুন নতুন সেমিপাকা ভবন তুলেছেন অনেকে।  

২০০৭ থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে পাহাড়ধসে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় ২০০৭ সালে। ওই বছরের ১১ জুন টানা বর্ষণের ফলে চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৭ সালে মারা যান ৩০ জন। আর সর্বশেষ শনিবার চট্টগ্রামের আকবর শাহ এলাকায় পৃথক পাহাড় ধসের ঘটনায় ৪ জন মারা গেছেন। 

চট্টগ্রামের রেলওয়ের লেকসিটি আবাসিক এলাকা-সংলগ্ন পাহাড়, পূর্ব ফিরোজ শাহ ১ নম্বর ঝিল-সংলগ্ন পাহাড়, কৈবল্যধাম বিশ্ব কলোনি পাহাড়, মতিঝর্ণা ও বাটালি হিলে, ফয়’স লেক, সীতাকুণ্ডের সলিমপুর, বায়েজিদ, আকবরশাহসহ বিভিন্ন এলাকার পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে অনেকে পাহাড়ে বসবাস করছেন।

অভিযোগ আছে, দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবশালীরা পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করলেও প্রশাসনের এ বিষয়ে তেমন নজর নেই।

আকবর শাহ থানার বরিশাল ঘোনা এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করেন শায়েলা বেগম। তৈরি করেছেন সেমিপাকা ঘর। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বামী সৌদি আরব থাকেন। বিয়ের পর থেকেই দেখেছি আমার শাশুড়ি এখানে বসবাস করছেন। আমরাও তাই এখানেই বসবাস করছি। বৃষ্টি হলে মানুষজন এসে নিরাপদে সরে যেতে বলে। এমনিতে কেউ কিছু বলে না। 

তিনি বলেন, সরকারিভাবেই এখানে বিদ্যুতের মিটার পেয়েছি। কার্ড রিচার্জ করে বিদ্যুৎ পাচ্ছি। এখানে আগে তো পাহাড়ধসের কোনো ঘটনা ঘটেনি। 

১০ বছর ধরে বরিশাল ঘোনা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন লোকমান। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার মালিকের নাম মনির হোসেন। তার ঘরে ১০ বছর ধরে বসবাস করছি। আমার আত্মীয়স্বজন সবাই এই এলাকায় থাকে। তাই আমিও আমার স্ত্রীকে নিয়ে এই এলাকায় থাকি। এখানে বাসা ভাড়া কম।  

পাহাড়ের গা ঘেঁষে তৈরি একটি ঘরে বসে ছিলেন আকলিমা আক্তার। স্বামীকে নিয়ে মাসখানেক আগে ঘরটি ভাড়া নিয়েছেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমরা কম ভাড়ার জন্য এখানে বসবাস করি। স্বামী কম আয় করেন। তাই বাধ্য হয়ে থাকতে হয়। পাহাড় ধসের ঘটনার পরে ভয় লাগছে। এখান থেকে বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাব।

সন্দ্বীপে নদী ভাঙনে ঘর হারা হোসনে আরা থাকেন বরিশাল ঘোনা এলাকায়। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, অন্য কোথাও বাসা ভাড়া দিয়ে থাকার সামর্থ্য নেই। তাই ঘর তুলে ছেলে-মেয়ে নিয়ে এই এলাকায় থাকি। তবে নিজের ঘরটিতে পাহাড় ধসের কোনো ঝুঁকি নেই বলে জানান তিনি।

পরিবেশ নিয়ে কাজ করা পিপলস ভয়েস’র সভাপতি শরীফ চৌহান ঢাকা পোস্টকে বলেন, চট্টগ্রাম শহরে যেসব পাহাড় আছে প্রতিটিরই মালিকানা আছে। পাহাড়ের মালিকদেরই প্রথম দায়িত্ব অবৈধভাবে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ করা। পাহাড়ের মালিকদের জবাবদিহিতার জায়গায় আনতে না পারলে মিটিং করে বা অন্যকিছু করে তাতে কিচ্ছু হবে না।

তিনি বলেন, ‘আমরা আগেই বলেছিলাম এ বছরও যদি বেশি পরিমাণে বৃষ্টি হয় তাহলে পাহাড়ধস হতে পারে। পাহাড়ে মানুষজন বসবাস করলে পাহাড়ধস হবে। পাহাড়ে মানুষকে থাকার সুযোগ দিলে তো মানুষ মরবে। আমরা বারবার বলেছি পাহাড়ে কোনো মানুষজন থাকবে না। যেহেতু অতিবৃষ্টির ফলে চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোতে পাহাড়ধসের আশঙ্কা সবসময় থাকে। সেখানে প্রশাসন যদি তাদেরকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে ব্যর্থ হয় তাহলে এই ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।' 

তিনি আরও বলেন, যাদের পাহাড়ে এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে তাদেরকেই এসব মৃত্যুর দায় নিতে হবে। পাহাড়গুলোর তো মালিকানা আছে। তারা মানুষজনকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছে কেন। সামান্য ঘর ভাড়া পাওয়ার লোভে তারা এ কাজ করেছে। তাই ধসের ঘটনায় পাহাড়ের মালিক এবং যারা দখল করছেন সবাই দায়ী। 

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. জহরুল আলম জসিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ওয়ার্ডের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পাহাড় ও পাহাড়ের আশপাশে বসবাস করে।  

কারা এসব দখল করছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এগুলো বিভিন্ন মানুষজন দখল করে ঘরবাড়ি তুলেছে, বস্তির মানুষজনও দখল করেছে। এখানে কারো একচেটিয়া দখল নেই। অনেকে ত্রিশ বছর ধরে এসব স্থানে বসবাস করছে। 

তিনি বলেন, বৃষ্টি হলেই মাইকিং করি, আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়। কিন্তু ঘরবাড়ি সম্পত্তি ছেড়ে মানুষজন আসে না। যে জায়গায় শনিবার পাহাড়ধসে মানুষ মারা গেছে সে পাহাড়গুলো রেলওয়ের।  

এ বিষয়ে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুক্রবার থেকেই মানুষজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে আসার জন্য মাইকিং করেছি। কিন্তু মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে চাইছে না। প্রতিটা আশ্রয় কেন্দ্রে স্বেচ্ছাসেবীও আছে। আজও মাইকিং করা হয়েছে।

তিনি বলেন, পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের উচ্ছেদে আগেও অনেকবার চেষ্টা করা হয়েছে। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠক আছে এ সপ্তাহেই। সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। চেষ্টা থাকবে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের অপসারণ করার। পাহাড়ে বহু মানুষজন থাকে। একসঙ্গে এত মানুষকে অপসারণ করা অনেক কঠিন। তারপরও আমাদের চেষ্টা থাকবে। বাস্তবতাটাও বুঝতে হবে। তবে আমাদের উদ্যোগ থাকবে যাতে আর কেউ পাহাড় ধসে প্রাণ না হারায়।

কেএম/জেডএস