স্বপ্নের পদ্মা সেতু তৈরিতে নিয়োজিত ছিলেন চার হাজার শ্রমিক। আজ তাদের মন খারাপ। কারণ, প্রকল্প এলাকা ছেড়ে তাদের চলে যেতে হচ্ছে / ঢাকা পোস্ট

দীর্ঘদিন ধরে যে বিশাল কর্মযজ্ঞের সঙ্গে জড়িত, তার মায়া ছেড়ে চলে যেতে হবে। এজন্য মন খারাপ। পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন চার হাজার মানুষ। তবে বাঙালি জাতির স্বপ্নের এ স্থাপনা নির্মাণে নিজেদের অংশগ্রহণকে গর্বের সঙ্গে দেখছেন তারা। 

দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল এ পদ্মা সেতু। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠনের পর সেতুটি নির্মাণের চিন্তাভাবনা শুরু হয়। ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে মূল পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়।

২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হতে শুরু করে পদ্মা সেতুর কাঠামো। এরপর একে একে ৪২টি পিলারে বসানো হয় ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যান। ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু পুরোপুরি দৃশ্যমান হয় ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর।

নানা আলোচনা-সমালোচনা, প্রতিবন্ধকতা, প্রতিকূলতা ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা। আজ (২৫ জুন) এর  উদ্বোধনের পর ২৬ জুন সকাল ৬টা থেকে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে স্বপ্নজয়ের এ সেতু। এর মাধ্যমে দেশে নতুন এক দিগন্ত উন্মোচিত হবে।

পদ্মা সেতু প্রকল্পে কর্মরত শ্রমিকরা জানিয়েছেন, এ প্রকল্প থেকে তাদের অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। এত বড় প্রকল্প তারা আর পাবেন কি না, তা নিয়েও সংশয় আছে। তবে, বিশাল এ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে নিজেদের গর্বিত মনে করছেন তারা।   

পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে গ্যাস লাইন সংযোগে দেড় বছর ধরে কাজ করেছেন উৎপল কুমার সরকার। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, এ প্রকল্পে কাজ করতে পেরে অনেক ভালো লাগছে। এখানে কাজ করার সুযোগ অনেকেই চেয়েছিলেন কিন্তু সবার ভাগ্যে তা জোটেনি। আমার মতো শ্রমিকের সেই সৌভাগ্য হয়েছে। অনেক অভিজ্ঞতাও অর্জন হয়েছে।

সেতুর নির্মাণযজ্ঞ শেষ, তাদের কাজও শেষ। এখন বাড়ি ফেরার পালা। দীর্ঘদিন কাটানোর পর এখন প্রকল্প এলাকা ছেড়ে যেতে একটু তো খারাপ লাগবেই তাদের / ঢাকা পোস্ট 

কিন্তু এখন তার মন খারাপ। উৎপল কুমার বলেন, প্রকল্প শেষ হয়ে যাওয়ায় অনেক খারাপ লাগছে। তারপরও ভালোয় ভালোয় সবকিছু শেষ হয়েছে। এখন তো যেতেই হবে। হয়তো সামনে অন্য কোনো প্রকল্পে যুক্ত হবো।

‘তবে, ভালো লাগার বিষয় হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সুন্দর সেতু তৈরি করে দিয়েছেন। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের সুবিধা হবে। প্রধানমন্ত্রী যে চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন, সেখানে তিনি সফল হয়েছেন। এটিই আমাদের বড় পাওয়া।’

পদ্মা সেতু প্রকল্পে কাজ করতে করতে প্রমত্ত পদ্মা ও সেতুর মায়ায় পড়েছেন শ্রমিক দেলোয়ার করিম। বিদায় বেলায় তারও মন খারাপ।

ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘এতদিন এ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত। নদী, সেতু আর পদ্মাপাড়ের লোকজন, সবার সঙ্গে যেন এক আত্মার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এখন কাজ শেষ, আমাদেরও সময় শেষ। সব ছেড়ে চলে যেতে হবে। তবে, ভালো লাগার বিষয় হলো কোনো দুর্ঘটনা এখানে ঘটেনি। সবকিছু ভালোয় ভালোয় শেষ হয়েছে।’

সুন্দর একটি প্রকল্প উপহার দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে দেলোয়ার বলেন, এখানে কাজ করে অনেক কিছু শিখলাম। হয়তো এমন প্রকল্প আর কখনও পাব না। নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতুর মতো বিশাল একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী যেমন দেশবাসীকে উপকার করলেন, আমরাও এ প্রকল্পের মাধ্যমে অনেক অভিজ্ঞতা পেলাম।

শহীদুল ইসলাম নামের অপর এক শ্রমিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, এর আগে অনেক প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। বিদায়ের বেলায় তেমন কিছু মনে হয়নি। কিন্তু এবার মনটা আর মানছে না। খুবই খারাপ লাগছে। কোটি কোটি মানুষের আবেগ আর ভালোবাসার এ সেতু। আর এর নির্মাণযজ্ঞে আমরা সরাসরি জড়িত ছিলাম। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সন্তানের মতো লালন-পালন করে এটিকে বড় করে তুলেছি। এখন সে পরিপূর্ণ। এ কারণে ছেড়ে যেতে একটু বেশিই খারাপ লাগছে।

ছিল আলোচনা-সমালোচনা, ছিল প্রতিবন্ধকতা-প্রতিকূলতা; ষড়যন্ত্রও কমতি ছিল না। সবকিছু মোকাবিলা করে পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান / ঢাকা পোস্ট

‘তবে, প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। এমন একটি প্রকল্প আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য। আসলে নিজ অর্থে তৈরি, ভালোবাসা আর টানের পরিমাণটা একটু বেশি হবেই’— যোগ করেন গর্বের পদ্মা সেতুর এ নির্মাণশ্রমিক।

সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো পদ্মা সেতু। দ্বিতল এ সেতুর এক অংশ মুন্সিগঞ্জের মাওয়া এবং অপর অংশ শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে যুক্ত। একই সঙ্গে রেল ও গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে এ সেতুতে। নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।

খরচের মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদীশাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি।

গত ১২ জুন মুন্সিগঞ্জ গিয়ে প্রকল্পের সর্বশেষ অবস্থা পরিদর্শন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ওইদিন তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘পদ্মা সেতু এখন স্বপ্ন নয়, এটি দৃশ্যমান বাস্তবতা। এটি আমাদের সামর্থ্য ও সক্ষমতার সেতু। একদিকে এটি সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক, অন্যদিকে সমালোচকদের জন্য প্রতিশোধের প্রতীকও।’

তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনা এ সেতু নির্মাণ করেছেন এবং বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, যারা আমাদের দুর্নীতি ও চুরির অপবাদ দিয়েছিল, আজ তারা দেখুক আমরা বীরের জাতি, দুর্নীতি করি না। এ সেতু আমাদের গর্বের সেতু। 

এসএইচআর/এমএআর/