ঈদ মানেই উৎসব আর আনন্দ। সারাদেশে এ সময় উৎসবের আমেজ বিরাজ করলেও ‘সড়ক দুর্ঘটনা’র মতো ঘটনা হঠাৎ বিষাদের কালো ছায়ায় ঢেকে দেয় ঈদ আনন্দ। একটি পরিবারকে ধুলায় ধূসরিত করতে একটি সড়ক দুর্ঘটনাই যথেষ্ট।

তবে, এবারের ঈদে (ঈদুল আজহা) মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। ফলে দুর্ঘটনা প্রায় অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের অনড় সিদ্ধান্তের কারণে গতবারের তুলনায় এ ঈদে ‘ম্যাজিক্যালি’ কমেছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা

এবারের ঈদে (ঈদুল আজহা) মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। ফলে দুর্ঘটনা প্রায় অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের অনড় সিদ্ধান্তের কারণে গতবারের তুলনায় এ ঈদে ‘ম্যাজিক্যালি’ কমেছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা

দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগীদের প্রধান ভরসাস্থল রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল)। সারাদেশ থেকে দুর্ঘটনায় আহত রোগীরা এসে ভিড় জমান এ হাসপাতালে। বিশেষ করে ঈদ এলেই পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে শুরু করে অস্ত্রোপচারসহ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা কক্ষের সামনে রোগী ও স্বজনদের দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। অন্যদিকে, রোগীদের সেবা দিতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের।

ঈদে মামাবাড়ি যাওয়ার পথে মায়ের হাত ধরে রাস্তা পার হচ্ছিল আট বছরের শিশু জিহাদ হোসেন। কিন্তু ভয়াবহ এক দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে তাকে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে জড়ানো সাদা ব্যান্ডেজ। শিশুটির চিৎকারে হাসপাতালের আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠছে।

গতবারের তুলনায় এবারের ঈদে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত রোগীর সংখ্যা কমেছে / প্রতীকী ছবি

গত মঙ্গলবার কিশোরগঞ্জের ভৈরবে দুর্ঘটনাটি ঘটে। দুর্ঘটনায় তার মা নাজমা বেগমও আহত হন। অসংখ্য রোগীর ভিড়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালের কোনো শয্যা মেলেনি তাদের। বাধ্য হয়ে মা-ছেলের স্থান হয় হাসপাতালে বারান্দায়। সেখানেই চিকিৎসা চলছে।

আরও পড়ুন >> ফ্লাইওভারের ওপর প্রাইভেট কার-মোটরসাইকেল সংঘর্ষে নিহত ৩ 

শিশু জিহাদ ও তার মা শুধু নয়, তাদের মতো অসংখ্য রোগীর স্থান হয়েছে হাসপাতালের বারান্দায়।

ঈদের আগের ও পরের তিনদিনে (মোট ছয়দিন) সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মোট ৬৫৭ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৫ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। গত ঈদে (ঈদুল ফিতর) এ সংখ্যা ছিল দেড় হাজারেরও বেশি। ওই সময় আহতদের ৩০ শতাংশ ছিল মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার। অনেকের হাত-পা কেটে ফেলতে হয়েছিল

হাসপাতালে ভর্তি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের বাসিন্দা নাহিদুল ইসলাম জানান, গত সোমবার রাতে মোটরসাইকেলে ভাইসহ তিনি বাজারে আসছিলেন। হঠাৎ পেছন থেকে একটি বাস ধাক্কা দিলে তারা দুজনই গুরুতর আহত হন। তবে, ভাইয়ের আঘাত কিছুটা কম হলেও তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। হাসপাতালে শয্যা না পেয়ে বারান্দায় শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছেন তিনি।

গতকাল (বৃহস্পতিবার) দুই পায়ে অস্ত্রোপচার হয়েছে। এখন পা হারানোর শঙ্কায় আছেন তিনি।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ঈদের আগের ও পরের তিনদিনে (মোট ছয়দিন) সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মোট ৬৫৭ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৫ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। গত ঈদে (ঈদুল ফিতর) এ সংখ্যা ছিল দেড় হাজারেরও বেশি। ওই সময় আহতদের ৩০ শতাংশ ছিল মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার। অনেকের হাত-পা কেটে ফেলতে হয়েছিল।

ঈদের আগের ও পরের তিনদিনে (মোট ছয়দিন) সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মোট ৬৫৭ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন / ঢাকা পোস্ট

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঈদের সময়ও আমাদের হাসপাতালে রোগীর চাপ থাকে। গত ঈদে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত রোগীর চাপ ছিল বেশ। তবে, এ ঈদে সেটা কমে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।

‘এবার ঈদ-পরবর্তী সময়ে পশু জবাই ও কাটাকাটি করতে গিয়ে আহত রোগী বেশি পেয়েছি। শতকরা হিসাবে যদি বলি, পশু জবাই ও কাটাকাটি সংক্রান্ত আহত রোগী প্রায় ৮০ শতাংশ। ১৫ শতাংশের মতো মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। বাকিরা বিভিন্নভাবে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।’

তিনি বলেন, গতবার আহত হয়ে হাসপাতালে আসা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ রোগী ছিল মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। এবার সেটা কমে ২০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। ম্যাজিক্যালি কমে আসার বড় কারণ যেটা আমার কাছে মনে হয়েছে, ঈদ উপলক্ষে সরকার মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচলের ওপর সাতদিনের বিধিনিষেধ দিয়েছিল। সেটা কাজে লেগেছে।

আরও পড়ুন >> ঈদে সড়কে ঝরেছে ৬৮১ প্রাণ, সবচেয়ে বেশি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়

এ বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবদুল গনি মোল্লা ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতি ঈদেই আমাদের একটা ভয়ংকর অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়। তবে, গতবারের তুলনায় এবার দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে আসা রোগীর সংখ্যা কিছুটা কম। এবারের ঈদে বাস, ট্রেন ও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় কিছু রোগী আসলেও অধিকাংশই এসেছে গরুর লাথি-গুঁতা খেয়ে অথবা গরু-ছাগলের মাংস বানাতে গিয়ে হাতে-পায়ে ছুরির আঘাত পেয়ে।

 গতবার আহত হয়ে হাসপাতালে আসা ৩০-৪০ শতাংশ রোগী ছিল মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। এবার সেটা কমে ২০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে / ঢাকা পোস্ট

তিনি বলেন, ঈদের দিন হাসপাতালে রেকর্ড সংখ্যক তিনশোর বেশি রোগী এসেছে। এরপর থেকে রোগী সংখ্যা কিছুটা কমেছে। তবে, গতবারের তুলনায় এবার মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার রোগীর সংখ্যা কম ছিল। যা ১০ থেকে ২০ শতাংশের বেশি হবে না। কারণ, এবারের ঈদে মোটরসাইকেল চলাচলের ওপর সরকারের একটা নিষেধাজ্ঞা ছিল। সেটা হয়তো কাজে লেগেছে।

হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, ঈদের আগের দিন শনিবার হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন ২৯৮ জন এবং ভর্তি হন ৮৭ জন। ঈদের দিন রোববার চিকিৎসা নিয়েছেন ২৭০ জন এবং ভর্তি হন ১২৯ জন। সোমবার (ঈদের পরদিন) চিকিৎসা নেন ২৬১ জন এবং ভর্তি হন ১০৬ জন। মঙ্গলবার চিকিৎসা নেন ২৩০ জন এবং ভর্তি হন ১১৬ জন। বুধবার সেবা নেন ২২৮ জন, ভর্তি হন ১০৯ জন। 

গতকাল (বৃহস্পতিবার) হাসপাতালটিতে দুর্ঘটনায় আহত হয়ে সেবা নেন ২৩৮ জন। তাদের মধ্যে ভর্তি হন ১১০ জন।

টিআই/এমএআর/