# মাদক বিজ্ঞানী হতে ব্যাপক অধ্যয়ন
# প্রতি পিস কুশ বিক্রি ২০/২৫ হাজারে
# তিন মামলা হচ্ছে ওনাইসী সাঈদের বিরুদ্ধে

নিজে মাদক সেবন করেন না। কিন্তু আমেরিকায় পড়াশোনা করার সময় নতুন মাদকে আগ্রহ জন্মে ওনাইসী সাঈদ ওরফে রেয়ার সাঈদের। সেই আগ্রহ থেকে বিভিন্ন অপ্রচলিত ও নতুন মাদক এক্সট্যাসি বিদেশ থেকে কখনো নিজে, কখনো পার্সেলের মাধ্যমে আমদানি করতেন। আর টাকা পাঠাতেন হুন্ডির মাধ্যমে। এরপর বিশ্বস্ত সার্কেলের মাধ্যমে হাতে হাতে তা রাজধানীর বিভিন্ন পার্টিতে সরবরাহ করতেন।

র‌্যাব বলছে, নতুন নতুন মাদক কীভাবে উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি ও বাজারজাত করা যায় তা নিয়ে বিস্তর অধ্যয়ন করতেন ওনাইসী সাঈদ। এ লক্ষ্যে তিনি রাজধানীর মোহাম্মদপুরে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাতকরণের উদ্দেশ্যে তাপ নিয়ন্ত্রণ গ্রো-টেন্ট এর মাধ্যমে অভিনব পন্থায় কুশ তৈরির প্লান্ট ও সেটআপ করেছিলেন।

গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে এক্সট্যাসি নামক একটি নতুন মাদকের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে জানতে পেরে র‌্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়। সবশেষ শনিবার রাতে রাজধানীর গুলশান থেকে ওনাইসী সাঈদকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাবের একটি দল। এসময় বাংলাদেশে সর্বপ্রথম অপ্রচলিত মাদক এক্সট্যাসি, কুশ, হেম্প এবং মলি, এডারল, ফেন্টানিলসহ অন্যান্য মাদক উদ্ধার ও প্রায় ৩ কোটি টাকা মূল্যের দেশি ও বিদেশি মুদ্রা জব্দ করা হয়। এক্সট্যাসি হলো মেথানিল ডাই-অক্সি মেথাফিটামিন।

মঙ্গলবার (২ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খোন্দকার আল মঈন। 

তিনি বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রচলিত নয়; কিন্তু বিভিন্ন উন্নত দেশে প্রচলিত এমন কিছু মাদকের ব্যবহার বাংলাদেশে পরিলক্ষিত হচ্ছে। যাতে ধীরে ধীরে আমাদের যুব সমাজ আসক্ত হয়ে উঠছে। তার প্রমাণ এই নতুন মাদকের সন্ধান। র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১ এর অভিযানে রাজধানীর গুলশান এলাকা থেকে ওনাইসী সাঈদকে গ্রেপ্তার করে। এসময় ১০১ গ্রাম কুশ, ৬ গ্রাম হেম্প, ০.০৫ গ্রাম মলি, ১ গ্রাম ফেন্টানল, ১৮ গ্রাম কোকেন, ১২৩ পিচ এক্সট্যাসি, ২৮ পিচ এডারল ট্যাবলেট এবং ২ কোটি ৪০ লাখ নগদ টাকা ও অর্ধ লক্ষাধিক মার্কিন ডলার উদ্ধার করা হয়। 

পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মোহাম্মদপুরের একটি ফ্ল্যাট বাসা থেকে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাতকরণের উদ্দেশ্যে তাপ নিয়ন্ত্রণ গ্রো-টেন্ট এর মাধ্যমে অভিনব পন্থায় বিদেশি প্রজাতির কুশ তৈরির প্লান্ট ও সেটআপ উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার ওনাইসী সাঈদ তার মাদক কারবার সংশ্লিষ্টতার নানা তথ্য দিয়েছে র‌্যাবকে। 

কমান্ডার মঈন বলেন, ওনাইসী সাঈদ বাংলাদেশে একটি স্বনামধন্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে আমেরিকায় যায়। সেখানে বিবিএ ও মালয়েশিয়ায় গিয়ে এমবিএ সম্পন্ন করে। ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশে অবস্থান করছে সে।
থাইল্যান্ডে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশের রাজধানীর এলিফেন্ট রোডের ফয়সাল নামক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। যার মাধ্যমে ওনাইসী সাঈদ নতুন নতুন মাদক সম্পর্কে জানতে পারে। ব্যবসায়িকভাবে নতুন মাদক কারবারে আগ্রহী হয়। থাইল্যান্ড থেকে বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করা ফয়সালেই নতুন মাদক সরবরাহকারী। আর এভাবেই ওনাইসি সাঈদ আন্তর্জাতিক মাদক সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত হয়।  

ওনাইসিকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, বাংলাদেশে নতুন মাদক এক্সট্যাসি’র অন্যতম প্রধান ওনাইসী সাঈদ প্রায় ৪ বছর ধরে এক্সট্যাসিসহ অন্যান্য উচ্চমূল্যের মাদকের কারবারের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশে ৭/৮ জন তার সহযোগী হিসেবে কাজ করে থাকে।

পার্সেলে, কখনো নিজে বহন করে আনত নতুন মাদক

বাংলাদেশে অপ্রচলিত মাদক এক্সট্যাসি, কুশ, হেম্প এবং মলি, এডারল, ফেন্টানিলসহ অন্যান্য মাদক পার্সেলের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করে থাকে। মাঝে মধ্যে ওনাইসী সাঈদ নিজেও বিদেশে গিয়ে লাগেজে এসব মাদক বহন করে দেশে আসত। তবে পার্সেলে মাদক আনার ক্ষেত্রে নিকটাত্মীয় ও বন্ধু-বান্ধবদের নাম ঠিকানা ব্যবহার করত। আর হুন্ডির মাধ্যমে সরবরাহ করা মাদকের অর্থ পরিশোধ করত নিজেই। 

অভিজাত পরিবারের সন্তানেরা এসব নতুন মাদকের ক্রেতা

অধিকাংশ ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানেরা তার নতুন মাদকের ক্রেতা। এছাড়া অভিজাত এলকায় বিভিন্ন পার্টিতে চাহিদার ভিত্তিতে সরবরাহ করে থাকে। মাদক পরিবহনের ক্ষেত্রে সে বিশ্বস্তদের নিয়োগ করে। এই বিশ্বস্তরা মাদক বিক্রির টাকা তার কাছে পুনরায় পৌঁছে দিত। তার নতুন মাদকের ব্যবহার হতো বিভিন্ন হোটেল-বারের পার্টিতে। 

জিজ্ঞাসাবাদে ওনাইসী সাঈদ জানিয়েছে, ২০১৪ সালের পর থেকে ধূমপান ও অ্যালকোহলে আসক্ত হলেও নিজে কখনো নতুন মাদকে আসক্ত হয়নি। তবে নতুন বিভিন্ন মাদকের প্রতি তার আগ্রহ সৃষ্টির ফলে তা নিয়ে অধ্যায়ন এবং গবেষণা শুরু করে। 

এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, প্রতি মাসে ৪০ থেকে ৫০ পিস কুশ মাদক তৈরি করে তা বিক্রি করত। প্রতি পিস তৈরিতে তার সবমিলিয়ে খরচ হতো ৪/৫ হাজার টাকা। কিন্তু প্রতি পিস বিক্রি করত ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায়।

পার্সেলে ও নিজে বহন করার সময় এই নতুন মাদক তল্লাশী করা হয়েছিল কি না জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, সে নিজে গত ডিসেম্বর ও গত এপ্রিলে লাগেজে করে এই মাদক আনে। কিন্তু বাংলাদেশে কখনো তার মাদকের চালান আটকা পড়েনি। তবে কিছুদিন আগে কানাডাতে তার একটি চালান আটকে যায়। 

আত্মীয়-স্বজনরাও জানে না তার মাদকের কারবার

বিদেশ থেকে নতুন মাদক পার্সেলে আনার ক্ষেত্রে তিনি আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের নাম ঠিকানা ব্যবহার করতেন। তবে বিশেষ প্রক্রিয়ায় আনা সেই মাদকের পার্সেল নিজে রিসিভ করে। আত্মীয়-স্বজনরা মনে করতেন, উন্নত দেশে তার যাতায়াত, পার্সেল আসা স্বাভাবিক। তবে পার্সেলে যে মাদক আসছে তা সে ছাড়া অন্য কেউ জানত না। 

মাদকবিজ্ঞানী হতে অধ্যয়ন, বিদেশে রপ্তানির পরিকল্পনায় ফার্ম তৈরি

তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অনুযায়ী, নতুন নতুন মাদক প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে উন্নত দেশে সরবরাহের লক্ষ্যে কুশ প্ল্যান্টের ফার্ম তৈরি করে। টেস্ট অ্যান্ড ট্রায়াল হিসেবে সে গত সাত মাস আগে ঢাকার মোহাম্মদপুরে ভাড়া ফ্ল্যাটের ভেতরে তাপ নিয়ন্ত্রণ গ্রো-টেন্ট পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু করে। সেই ফার্ম থেকে একবার হারভেস্ট ও পরে প্রসেস করে কুশ মাদক ‍উৎপাদন করে। যা বাংলাদেশের বিভিন্ন মাদকাসক্তের কাছে বিক্রি করে। নতুন মাদক প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে বিক্রি করে ব্যবসায়ীকভাবে লাভবান হওয়াই ছিল তার লক্ষ্য। 

ওনাইসী সাঈদের বিরুদ্ধে তিন মামলা

নতুন মাদকের আমদানি, প্রক্রিয়াজাতের বিষয়টি তদন্ত করবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এই নতুন মাদকের আমদানি করতে গিয়ে বিদেশে মুদ্রা অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করেছে সে। সবমিলে তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং, মাদক মামলা, বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হবে। সিআইডি মানি লন্ডারিং মামলা তদন্ত করবে। 

আফিমের চেয়ে ৫০ গুণ, ফেন্টালন, মারিজুয়ানার চেয়ে ৫০ গুণ শক্তিশালী কুশ 

এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, আমরা জব্দ করা সব মাদক ল্যাবে পরীক্ষা করব। প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি, আফিমের চেয়ে ৫০ গুণ শক্তিশালী হচ্ছে জব্দ ফেন্টালন। আর মারিজুয়ানার চেয়ে ১২ গুণ শক্তিশালী মাদক কুশ। এসব মাদক সেবনে স্নায়ু উদ্দীপনা তৈরি করে। ৪/৫ ঘণ্টার জন্য পার্টি মুড তৈরি করে। এখন পর্যন্ত সে ১০০ গ্রাম কুশ মাদক বিক্রি করেছে ৩ লাখ টাকায়। এভাবে ৪০০ গ্রাম বিক্রি করেছে।

জেইউ/জেডএস