কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল এক্সপ্রেস পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনায় মোট ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সদস্যরা। গত ২ আগস্ট টাঙ্গাইল এলাকায় সংঘটিত ওই ঘটনায় রোববার (৭ আগস্ট) রাতে ঢাকা, গাজীপুর ও সিরাজগঞ্জ থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে র‌্যাবের একাধিক দল।

সোমবার (৮ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন র‌্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি বলেন, মহাসড়কে যাত্রীবাহী গণপরিহনসহ অন্যান্য পরিবহনে ডাকাতির ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায় এড়াতে পারে না। অবশ্যই আমাদের দায়-দায়িত্ব রয়েছে। তবে পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও যাত্রীদেরও দায় রয়েছে। কারণ মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনা ঘটছে রাতে। এর নেপথ্যে কিছু কারণ উঠে এসেছে। হাইওয়েতে যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো, কাউন্টারে যাত্রী না তোলা, টিকিট না বিক্রি করেও যাত্রী তোলার সুযোগে ডাকাত দল বাসে উঠছে সংঘবদ্ধভাবে।

কাউন্টারে সিসি ক্যামেরা রাখা, বাসে যাত্রীদের ছবি তোলা, লাগেজ চেকিং করা, বিশেষ করে রাতে যত্রতত্র যাত্রী পরিবহন বন্ধ হলে মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনা অনেকাংশে কমে যেতো বলে মন্তব্য করেছেন র‌্যাবের এ কর্মকর্তা।

খন্দকার আল মঈন বলেন, সম্প্রতি মহাসড়কে আন্তঃজেলা ডাকাত চক্রের বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেটকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। গত দুই আগস্ট রাত ১টার দিকে কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল এক্সপ্রেস পরিবহনের একটি বাস টাঙ্গাইল অতিক্রম করার সময় ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ওই ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনায় মধুপুর থানায় অজ্ঞাত ১০/১২ জনকে আসামি করে একটি মামলা হয়। ডাকাতি ও একই সময়ে ধর্ষণের ঘটনায় র‌্যাব জড়িতদের গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়।

র‌্যাব সদর দপ্তর গোয়েন্দা শাখা, র‌্যাব-১২ ও র‌্যাব-১৪ এর আভিযানিক দল রোববার (৭ আগস্ট) বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত ঢাকা, গাজীপুর ও সিরাজগঞ্জ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ওই ডাকাতির মূল পরিকল্পনাকারী রতন হোসেন (২১), ডাকাত দলের সদস্য আলাউদ্দিন (২৪), সোহাগ মন্ডল (২০), খন্দকার হাসমত আলী ওরফে দীপু (২৩), বাবু হোসেন ওরফে জুলহাস (২১), মো. জীবন (২১), আব্দুল মান্নান (২২), নাঈম সরকার (১৯), রাসেল তালুকদার (৩২) ও আসলাম তালুকদার ওরফে রায়হানকে (১৮) গ্রেপ্তার করেছে। এসময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ২০টি মোবাইল ফোন, ২টি রূপার চুড়ি, ১৪টি সিমকার্ড ও ডাকাতিতে ব্যবহৃত ১টি দেশীয় অস্ত্র (ক্ষুর)।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, ওই ডাকাতির মূল পরিকল্পনাকারী রতন মিয়া। তিনি রাজা মিয়াকে বাস ডাকাতির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। রাজা দলের অন্যান্য ডাকাতদের সংগঠিত করার কথা বলে। রতনের নেতৃত্বে গত ২ আগস্ট গাজীপুরের জিরানী বাজার এলাকায় সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী বাস ডাকাতির পরিকল্পনা হয়। রতন নিজেই প্রস্তুতির আর্থিক খরচ দেয়। টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা মোড়ের একটি দোকান থেকে ৪টি চাকু, ২টি ধারালো কাঁচি ও ১টি ক্ষুর কিনে। ডাকাতিতে অংশ নেয় ১৩ ডাকাত। তাদের অনেকে স্বনামধন্য গার্মেন্টেসে চাকরি করেন। এর আড়ালে তারা পেশাদার ডাকাত। প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের পূর্ব থেকেই যোগাযোগ ছিল। প্রত্যেকেই একাধিক ডাকাতি ও ছিনতাই মামলার আসামি এবং একাধিকবার কারাভোগ করেছেন।

গ্রেপ্তাররা জানিয়েছে, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ডাকাতির রাতে রাজাসহ চক্রের অন্যান্য সদস্যরা সিরাজগঞ্জ রোড মোড় এলাকায় ঘোরাঘুরি করতে থাকে। রাত ১টার দিকে কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল এক্সপ্রেস পরিবহনের একটি বাস সিরাজগঞ্জ রোড মোড় এলাকায় পৌঁছালে ডাকাত রাজা বাসটিকে থামার সংকেত দেয়। যাত্রীবেশে প্রথমে রতন, রাজা, মান্নান ও নুরনবী ঈগল এক্সপ্রেস পরিবহন বাসটিতে ওঠে। পরে আরও দুই দফায় ডাকাতচক্রের অন্য সদস্যরা বাসটিতে যাত্রীবেশে আরোহন করে। বাসটিতে ২৪ জন সাধারণ যাত্রী থাকায় ডাকাত চক্রের অধিকাংশ সদস্য বাসের পেছনের দিকে বসে। বাসটি বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু এলাকা অতিক্রম করার পর গ্রেপ্তার রতন ডাকাত দলের সদস্যদের চাকু ও ধারালো কাঁচি দেয়। আউয়াল ধূমপানের কথা বলে বাসের দরজার কাছে যায় এবং অন্যদের ইশারা করলে রাজা, রতন, মান্নান ও নূরনবী ড্রাইভিং সিটের কাছে গিয়ে চালককে মারধর করে। ডাকাত রতন ড্রাইভিং সিটে বসে বাসের নিয়ন্ত্রণ নেয়।

ডাকাত দলের বাকিরা বাসের চালক, সুপারভাইজার, হেলপারসহ অন্য সাধারণ যাত্রীদের হাত-মুখ বেঁধে সিট কভার দিয়ে মুখোশ পড়িয়ে দেয় এবং যাত্রীদের সঙ্গে থাকা নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে। এ সময় শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটায়।

পরে টাঙ্গাইলের হাটুভাঙ্গা মোড় হয়ে মধুপুরে যাওয়ার পথে মধুপুরের রক্তিপড়া এলাকায় গ্রেপ্তার হওয়া রতন গাড়ি চালনোর সময় লুটকরা মালামাল নিয়ে ডাকাত দলের সদস্যদের মধ্যে বাক-বিতণ্ডার শুরু হয়। এসময় রতন পেছনে তাকালে বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে বালুর মধ্যে হেলে পড়ে। এসময় ডাকাতদলের সবাই লুটকরা মালামালসহ দ্রুত নেমে যায়।

ডাকাতির ঘটনার পর রতনের নিকটাত্মীয়ের ফাঁকা বাড়িতে গিয়ে লুন্ঠিত মালামাল ভাগ-বাটোয়ারা করে সবাই বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে চলে যায়।

জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, গ্রেপ্তার রতন হোসেন পেশায় গাড়ির হেলপার। তার বিরুদ্ধে পূর্বেও ডাকাতির অভিযোগে মামলা হয়েছে। রতন ২০১৮ সালে নূরনবী, জীবন ও অন্যান্য কয়েকজনকে নিয়ে রোডব্লক করে সাভার পরিবহনের একটি বাস ডাকাতি করে। ওই বাস ডাকাতির ঘটনায় রতন গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় দেড় বছর কারাভোগ করে। জামিনে বের হয়ে ২০২০ সালে পুনরায় গ্রেপ্তার নূরনবী, জীবন ও আউয়ালকে নিয়ে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে একটি অটোরিকশা ছিনতাই করে। তখন ঘটনাস্থলে উপস্থিত জনতা জীবনকে ধাওয়া করে ধরে ফেলে। ওই ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়ে রতন প্রায় এক বছর কারাভোগ করে। কারাভোগের পর জামিনে বের হয়ে সে তার সিন্ডিকেট নিয়ে সাভার, গাজীপুর বা সিরাজগঞ্জ এলাকায় মহাসড়কে আরও বেশ কয়েকটি ডাকাতি করে।

গ্রেপ্তার জীবন পেশায় গাড়ির হেলপার। হেলপার পেশার আড়ালে সে বেশ কয়েকটি পরিবহন ডাকাতিতে অংশগ্রহণ করে। রতন দুটি ডাকাতির মামলার আসামি এবং বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগও করেছে।

গ্রেপ্তার মান্নান গাজীপুরের একটি গার্মেন্টস এ চাকরি করে। ২০১৯ সালে আশুলিয়া থানায় একটি চুরির মামলায় কারাভোগ করেছে মান্নান। তার নেতৃত্বে ঢাকা ও গাজীপুরের বিভিন্ন গার্মেন্টসে চাকরিরত গ্রেপ্তার আলাউদ্দিন, সোহাগ, বাবু, দীপু, রাসেল, রায়হান, নাঈম ডাকাতিতে অংশগ্রহণ করে।

এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, ডাকাত দলের সদস্যদের মধ্যে যোগাযোগ ও পরিচয় আগে থেকেই। তাদের মধ্যে অনেকের পরিচয় জেলখানাতেই। জেল থেকে বেরিয়ে আবার ডাকাতিতে অংশ নিচ্ছে।

বাসে ধর্ষণের ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেন, বাসে একজন নারী যাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে জেনেছি। বাস ডাকাতিতে জড়িতরা জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে তারা একাধিক নারীকে শ্লীলতাহানি করেছেন। তবে ধর্ষণের ঘটনা একটিই। ডাকাতির পূর্ব পরিকল্পনা থাকলেও তাদের ধর্ষণ-শ্লীলতাহানির পরিকল্পনা ছিল না।

জেইউ/এসএম