পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন/ ফাইল ছবি

‘বেহেশতে’ থাকা নিয়ে বক্তব্যের জন্য সমালোচনার মুখে পড়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, ‘কথা বলায় সতর্ক থাকতে দলের কাছ থেকে বার্তা পেয়েছেন। ভবিষ্যতে কথা বলার সময় সাবধান হবেন।’ 

অথচ সতর্কবার্তা পাওয়ার কথা বলে চারদিন পার না হতে নতুন করে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন ড. মোমেন। বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘ভারতকে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন মন্তব্য নিয়ে বিরক্ত খোদ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, ‘দায়িত্বশীল পদে থেকে বেফাঁস মন্তব্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এমন মন্তব্যের মাধ্যমে মন্ত্রী শুধু নিজেকে ছোটই করেননি, দেশকেও ছোট করেছেন। আর দেশে সরকার টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব দেশের মানুষের, অন্য দেশের হতে যাবে কেন।’

সাবেক কূটনীতিকরাও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, ‘মন্ত্রীর এমন বক্তব্য দেশের জন্য এবং দলের জন্য মর্যাদাহানিকর। তাই মন্ত্রীর বক্তব্য খতিয়ে দেখার পাশাপাশি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এর ব্যাখ্যা দিতে হবে।’

নাম প্রকাশ না করা শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যৈষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘ওনাকে (মোমেন) বারবার বার্তা দেওয়া হয়, যেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা না বলেন। কিন্তু এরপরও তিনি (মোমেন) বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করেই যাচ্ছেন। বুঝে নাকি না বুঝে বলেন, সেটাই তো বুঝতে পারছি না। দায়িত্বশীল পদে থেকে উনি শুধু দেশকে নয়, মন্ত্রণালয়কেও ছোট করছেন।’

মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশে সরকারের টেকানোর দায়িত্ব দেশের মানুষের। দেশের মানুষ নির্বাচন করবে কে সরকার হবে। অন্যদেশ বাংলাদেশে সরকারকে ক্ষমতায় রাখার কেউ না। উনি (মোমেন) কেন এমন মন্তব্য করেছেন, উনি (মোমেন) বলতে পারবেন।’

আরও পড়ুন : পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য ব্যক্তিগত, ভারতকে অনুরোধ করেনি আ.লীগ

সাবেক রাষ্ট্রদূত মুনশি ফায়েজ আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এটা গোপনে বা প্রকাশ্যে কোনোভাবেই বলা উচিত না। এটা কেন উনি বলতে যাবেন। আমাদের সরকারকে কি ভারত টিকিয়ে রাখছে? আমাদের সরকার টিকিয়ে রেখেছে আমাদের দেশের মানুষ। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজেই তো বলেন, মানুষ যখন চাইবে না, থাকব না; এটাতো উনি বিভিন্ন সময়ে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমার কোনো চাওয়া পাওয়া নাই, আমার একমাত্র উদ্দেশ্য কীভাবে মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন করা যায়। তার জন্য বাহিরের কাউকে টিকিয়ে রাখতে বলতে যেতে হবে কেন?’

চীনে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা এ কূটনীতিক বলেন, আর এ রকম যদি প্রয়োজন পড়ে তাহলে কেউ এ রকম হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে সেটা বলে না কি? ওনার মন্তব্য আমাদের রাষ্ট্রের জন্য যেমন মর্যাদাহানিকর তেমনি দলের (আওয়ামী লীগ) জন্যও মর্যাদাহানিকর। এটা উনি কেন বলেছেন, সেটা নিয়ে দেখার বিষয় আছে। এ রকম করে তো বলা উচিত না। এভাবে কথা বলে উনি নিজে তো ছোট হচ্ছেনই, সঙ্গে সঙ্গে দেশসহ সবাইকে ছোট করেছেন। এ রকম বলার কোনো মানে হয় না। এমন মন্তব্যের জন্য ওনাকে দায়িত্ব নিতে হবে।’

সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির বলেন, ‘উনি কি কারণে এটা বলেছেন আমি বলতে পারব না। উনি কোন দৃষ্টিকোণ থেকে কথাটা বলেছেন, সেটাও আমি বলতে পারব না। উনি কেন এমন মন্তব্য করছেন এটার ব্যাখ্যা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দেওয়া উচিত। কোন পরিপ্রেক্ষিতে উনি এটা বলেছেন এবং এটার কারণ কি এর ব্যাখ্যা তাকে (মোমেন) দিতে হবে। উনি একবার বলছেন, আমরা ‘বেহেশতে’ আছি। কথা হচ্ছে, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা আলাদা প্রেক্ষিত আছে। আপনার মনে চাইল একটা মন্তব্য করে দিলেন, এটা তো ঠিক না।

বৃহস্পতিবার (১৮ আগস্ট) সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম শহরের জে এম সেন হলে জন্মাষ্টমী উৎসবের অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, সেটি করতে ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছে। তিনি বলেন, আমি ভারতে গিয়ে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে।

চট্টগ্রামে জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্য নিয়ে শুক্রবার (১৯ আগস্ট) গোপালগঞ্জের টুঙ্গি পাড়ায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে। সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ভারতকে অনুরোধ করার ব্যাখ্যায় ড. মোমেন বলেন, আমি বলেছি, আমরা চাই শেখ হাসিনার স্থিতিশীলতা থাকুক। এই ব্যাপারে আপনারা (ভারত) সাহায্য করলে আমরা খুব খুশি হব।

এর আগে, গত ১২ আগস্ট সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ বিষয়ক এক মতবিনিময় সভা শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, বৈশ্বিক মন্দায় অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ ভালো আছে। দেশের মানুষ ‘বেহেশতে’ আছে

মন্ত্রীর এমন বক্তব্যে দেশজুড়ে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হয়। এর দুই দিনের মাথায় গত ১৪ আগস্ট রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান মিশেল ব্যাশেলের সঙ্গে বৈঠকের পর ড. মোমেন গণমাধ্যমকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, আমি তো ট্রু সেন্সে ‘বেহেশত’ বলিনি। কথার কথা। কিন্তু আপনারা সবাই আমারে খায়া ফেললেন

ওইদিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই বলেছিলেন, ভবিষ্যতে কথা বলার সময় সাবধান হবেন।

এনআই/আইএসএইচ