শ্রীমঙ্গলের চা-শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাপে এই টাকায় দিনের খাবার জোটানো যেখানে কষ্টকর, সেখানে কেউ অসুস্থ হলে সেটা তাদের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ এর মতো। ‘অভাবের’ কারণে কোনো শ্রমিক গুরুতর অসুস্থ হলেও উন্নত চিকিৎসা করাতে পারেন না। আবার মালিকপক্ষের ভরসায় চিকিৎসা করালেও তারা চিকিৎসার ব্যয়ের মাত্র ২৫-৩০ শতাংশ বহন করেন। চা-বাগানের যে মেডিকেল সেন্টার রয়েছে সেখানে মেলেনা যথাযথ চিকিৎসা। তাই উন্নত চিকিৎসা শ্রমিকদের কাছে অনেকটা ‘বিলাসিতার’ মতো। এ অবস্থায় অসুস্থ হলেও অনেক সময় ঘরেই পড়ে থাকতে হয় বলে অভিযোগ শ্রমিকদের। 

শ্রীমঙ্গলের সাতগাঁও চা বাগানের শ্রমিক সুমন ভৌমিক জানান, বছরখানেক আগে তাদের বস্তির একটি পরিবারে এক দিনের মাথায় দুই বোন মারা যায়। তাদের পাতলা পায়খানা হয়েছিল। তারপর বমি। হাসপাতালে গেলে কম্পাউন্ডার ফ্ল্যাজিল ট্যাবলেট দেন। কিন্তু তাতে অসুখ সারেনি। মেয়ে দুটি ঘরেই মারা গেছে।

আরও পড়ুন>> ছোট্ট ঘরের এক পাশে গরু, অন্য পাশে চা-শ্রমিকের পরিবার

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা যে মজুরি পাই তা দিয়ে সংসারই ঠিকমতো চলে না। অসুুস্থ হলে বাগানের মেডিকেল সেন্টারই আমাদের ভরসা। কারণ উন্নত চিকিৎসা নেওয়ার মতো টাকা তো আমাদের নেই। আবার মেডিকেল সেন্টারে গেলে ঠিকমতো চিকিৎসা পাই না। গত বছর আমাদের বস্তির দুটি মেয়ের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তাদের বড় কোনো রোগ হয়েছে, যা মেডিকেল সেন্টারের লোকজন ধরতে পারেনি। পাতলা পায়খানার ওষুধ দিয়েছে। তাদের কাছে জ্বর, শরীরের কোনো ভিন্ন অংশে ব্যথার চিকিৎসার জন্য গেলে প্যারাসিটামল দেয়। মাঝেমধ্যে কাউকে লাল ট্যাবলেট (ডাইক্লোফেনাক) দেওয়া হয়। আর পাতলা পায়খানাসহ পেটে ব্যথা নিয়ে গেলে দেওয়া হয় ফ্ল্যাজিল। সব জায়গায় মালিকপক্ষ বলে আমাদের জন্য লাখ লাখ টাকার ওষুধ কেনে, কিন্তু সেগুলো আসলে কাকে দেয়?

শ্রীমঙ্গলের কয়েকটি চা বাগানের শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এবং বালিশিরা সেন্ট্রাল হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই এলাকার প্রতিটি বাগানের জন্য একটি করে মেডিকেল সেন্টার আছে। আর কেন্দ্রীয়ভাবে আছে বালিশিরা সেন্ট্রাল হাসপাতাল। প্রতিটি বাগানের জন্য একটি মেডিকেল সেন্টার থাকলেও সবগুলোতে ডাক্তার থাকেন না। তিনটি মেডিকেল সেন্টারের রোগী দেখেন একজন ডাক্তার। তাও সপ্তাহের বার ও সময় নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। ওই সময়ের পরে গেলে তাকে আর পাওয়া যায় না। তার অনুপস্থিতিতে কম্পাউন্ডার, হেলথ সুপারভাইজার, মিডওয়াইফ এবং পুরুষ ও নারী ড্রেসার কাজ করে।

কালীঘাট চা বাগানের শ্রমিকরা জানান, কালীঘাট, ফুলছড়া ও জঙ্গলবাড়ী এই তিনটি বাগানের জন্য একজন ডাক্তার। ভোর ৬টায় গেলে ডাক্তার পাওয়া যায়, নয়তো পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় ড্রেসার দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এমনকি বেশি জরুরি না হলে ডাক্তার সব মেডিকেল সেন্টারে যান না।   

কালীঘাট চা বাগানের শ্রমিক নিরাকার তুলসী প্রসাদ বলেন, ভোর ৬টার পরে গেলে আর ডাক্তার পাই না। গ্যাস্ট্রিকজনিত সমস্যার কারণে মেডিকেল সেন্টারে গেলে এন্টাসিড, সর্দির জন্য গেলে হিসটাসিন আর জ্বর হলে নাপা কিংবা প্যারাসিটামল। আবার জ্বর-সর্দি-কাশি এগুলো অনেক বড় রোগের লক্ষণ বলে জানি। কিন্তু মেডিকেলে গেলে তারা এসব অসুখ হয়েছে শুনেই ওই ওষুধগুলো (এন্টাসিড, হিসটাসিন, প্যারাসিটামল) ধরিয়ে দেয়।

শ্রমিকরা জানান, চা-বাগানে সাপ, জোঁক ও বিষাক্ত পোকা থাকে। দিনের মধ্যে ২৪ কেজি চা পাতা তোলা অনেক কষ্টের। সেজন্য কেউ চা-পাতা তোলার সময় অন্যকোনো দিকে নজর দিতে পারে না। কোনো শ্রমিককে সাপে কাটলে বিভিন্ন ধরনের লতা-পাতা দিয়ে প্রথমে সনাতনী চিকিৎসা দেওয়া হয়। এতে কাজ না হলে মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় বালিশিরা সেন্ট্রাল হাসপাতাল বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে চিকিৎসা নিতে যে টাকা খরচ হয়, তা দিয়ে পুরো সপ্তাহের খরচের টাকা শেষ হয়ে যায়।

উপজেলা কমপ্লেক্সের নিম্নমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়েও বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রতিবেদন হয়েছে। সেসব প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ৫০ শয্যাবিশিষ্ট এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জন্য পর্যাপ্ত ডাক্তার নেই। সে কারণে অনেকেই দ্রুততম সময়ে কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা পান না।

চা-শ্রমিকরা আরও জানান, কোনো শ্রমিক গুরুতর অসুস্থ হলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানেও কাজ না হলে সিলেট মেডিকেলে। এক্ষেত্রে মালিকপক্ষ থেকে কিছুটা সহযোগিতা করা হয়। তবে সেটা যথেষ্ট নয়। কারো  চিকিৎসার পেছনে ভাড়াসহ খরচ যদি হয় বিশ হাজার টাকা, মালিকপক্ষ বিভিন্ন দিকে কেটে-ছেঁটে তাদের টাকা দেয় ৫-৬ হাজার টাকা। আবার সময়মতো অ্যাম্বুলেন্সও পাওয়া যায় না।

চা-শ্রমিক নিরাকার তুলসী প্রসাদ বলেন, একজন শ্রমিকের চিকিৎসার পেছনে যদি ২০ হাজার টাকা খরচ হয়, তখন মালিকপক্ষের কাছে খরচের তালিকা নিয়ে গেলে তারা বলে, ভাড়ায় আরও কম খরচ হয়েছে, চিকিৎসায় এত বিল হবে না। এসব বলে তারা ৫-৬ হাজার টাকা দেয়। কারো ৩০ হাজার টাকা খরচ হলে দেয় ৮-৯ হাজার টাকা। গুরুতর অসুস্থ কাউকে জরুরি ভিত্তিতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যেতে সবসময় অ্যাম্বুলেন্সও পাওয়া যায় না। রোগী যত অসুস্থই থাকুক, মালিকপক্ষের অনুমতি ছাড়া অ্যাম্বুলেন্স স্টার্ট দেওয়া হয় না।

মঙ্গলবার (২৩ আগস্ট) বেলা ১২টার দিকে কালিঘাট মেডিকেল সেন্টারে গিয়ে ডাক্তারের দেখা পাওয়া যায়নি। কম্পাউন্ডার বা হেলথ সুপারভাইজারও নেই। একজন পুরুষ ড্রেসার কাজ করছেন, আর একজন এনজিওর স্বাস্থ্যকর্মী যক্ষ্মার নমুনা নেওয়ার জন্য উপস্থিত আছেন।

পাশেই কেবিনে চার-পাঁচ বছর বয়সের এক বাচ্চা পেটে ব্যথায় ছটফট করছে। তাকে কারমিনা সিরাপ খেতে দিয়ে তার বাবাকে ছোট্ট কাগজের টুকরোয় লিখে এলজিন সিরাপ কিনে আনতে বলা হয়েছে। এদিকে, সাংবাদিক আসার খবরে তড়িঘড়ি করে ওই বাচ্চাকে এলজিন ট্যাবলেট খাইয়ে দেওয়া হয়। এলজিন সিরাপ কি মেডিকেল সেন্টারে নেই? জানতে চাইলে ওই পুরুষ ড্রেসার বলেন, বাচ্চাটিকে পেটে ব্যথার জন্য সিরাপ খাইয়ে দিয়েছি। আর এলজিন ট্যাবলেট খাইয়েছি। ওষুধ আনতে বলিনি।

এই মেডিকেল সেন্টারে দুটো রুম কেবিন হিসেবে ব্যবহার হয়, একটি পুরুষ অন্যটি মহিলা কেবিন। একটি রুমে ৬টি করে বেড দেওয়া। পুরুষ কেবিনে গিয়ে তিনজন রোগী দেখা গেলেও মহিলা কেবিনে কোনো রোগী দেখা যায়নি। এই কেবিনে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বেডগুলো ছড়ানো-ছিটানো। আবার বেডের মানও উন্নত নয়। এখানে পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আয়রন দেখা গেছে।

মেডিকেল অফিসারের কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, বেসিনের অবস্থা ভালো নয়। নিয়মিত পরীষ্কার না করায় এখানে আয়রন জমাসহ বেসিনে দাগ পড়ে গেছে।

বালিশিরা সেন্ট্রাল হাসপাতালের ক্লার্ক তপন বিশ্বাস বলেন, আমাদের এখানে সব ধরনের ওষুধ পাওয়া যায়। নাপা, নাপা এক্সট্রা, প্যারাসিটামল, এইচ, হিসটাসিন, ফ্ল্যাজিল, ডাইক্লোফেনাক এর পাশাপাশি সেফথ্রি, ফাইমক্সিল, ফ্লুক্লক্সসহ বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধও দেওয়া হয়। শুধু নাপা কিংবা প্যারাসিটামল নয়, যার যা সমস্যা সেই অনুযায়ীই চিকিৎসা দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বালিশিরা সেন্ট্রাল হাসপাতালের ইনচার্জ ডা. নাদিরা বলেন, শ্রমিকদের অভিযোগের ভিত্তি নেই। কারণ বছরে আমাদের ৪০-৪৫ লাখ টাকার ওষুধ কিনতে হয়। আমরা শুধু প্যারাসিটামল নয়, দামি এন্টিবায়োটিক ওষুধও দেই। অবস্থা গুরুতর হলে তাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠিয়ে দেই।

তিনি বলেন, শ্রমিকদের বেশিরভাগই ঠান্ডা মেজাজের। কিন্তু কেউ হয়তো তাদের উসকে দেওয়ার জন্য এসব অভিযোগ করছে।

অ্যাম্বুলেন্স না পাওয়া সংক্রান্ত শ্রমিকদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. নাদিরা বলেন, একজন শ্রমিক গুরুতর অসুস্থ হলে তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদের এখানে একটির বেশি অ্যাম্বুলেন্স রাখার জায়গা নেই। তাই একই সময় অন্য কেউ অসুস্থ হলে অন্য কোনো জায়গা থেকে আরেকটি অ্যাম্বুলেন্স সবসময় ব্যবস্থা করা যায় না।

মালিকপক্ষের অনুমতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবার ওপরে বস আছে, আমাদেরও আছে। অনুমতি নেওয়া তো বাঞ্ছনীয়। কোনো শ্রমিককে হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন হলে অ্যাম্বুলেন্স যার অধীনে, তার অনুমতি তো নিতে হয়।

এএজে/জেডএস