সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী গ্রামীণ টেলিকমের ১২ বছরের লভ্যাংশ ৪৩৭ কোটি টাকা শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টন হওয়ার কথা থাকলেও ২৬ কোটি টাকার হিসাব মিলছে না কিছুতেই।

মূলত শ্রমিকদের টাকা বণ্টন না করে গ্রামীণ টেলিকম এমপ্লোয়ি ইউনিয়নের অ্যাকাউন্টে জমা করা হয়েছিল। সেখান থেকে দুই আইনজীবী ও শ্রমিক ইউনিয়নের তিন নেতা ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়ে নেন সেই টাকা। যার বড় অংশ যায় আইনজীবী ইউসুফ আলীর পকেটে।

আরও পড়ুন : ঢাকায় ৯ ফ্ল্যাট ২ প্লট পাসপোর্ট অধিদপ্তরের পরিচালকের

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শ্রমিকদের ২৬ কোটি টাকার প্রথম দফায় আইনজীবী ইউসুফ আলীর আইনি প্রতিষ্ঠান নেয় ১ কোটি, গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মো. কামরুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদ হাসান ও ইউনিয়নের অপর নেতা মো. মাইনুল ইসলাম প্রত্যেকে নেন ৩ কোটি টাকা, ইউসুফ আলী নতুনভাবে পুনরায় ব্যাংক হিসাব খুলে নেন ৯ কোটি টাকা। এছাড়া ইউসুফ ও অপর আইনজীবী জাফরুল হাসান চৌধুরী যৌথভাবে ব্যাংক হিসাব খুলে ফান্ড ট্রান্সফার করে নেন ৬ কোটি টাকা। ভাগ-বাটোয়ারার মধ্যে ১৬ কোটি টাকাই যায় আইনজীবী ইউসুফ আলীর কাছে।

দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বে একটি টিম বৃহস্পতিবার আইনজীবী ইউসুফ আলী ও জাফরুল হাসানকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তারা যথাযথ জবাব দিতে পারেননি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।  

দুদক সূত্রটি জানায়, বারবার নিজের অবস্থানের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন তারা। কিন্তু ব্যাংকের হিসাব বিবরণীর সঙ্গে তাদের বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায়নি। 

আরও পড়ুন : যোগ-বিয়োগের কারসাজিতে কোটি কোটি টাকা লোপাট!

যদিও অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সাংবাদিকদের ইউসুফ আলী বলেন, আপনারা জানেন অনুসন্ধান চলছে। তারা (দুদক) সবকিছু দেখছেন। আমরা আমাদের সব বক্তব্য উপস্থাপন করেছি, তারা অনেকক্ষণ ধরে শুনেছেন। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, সেটা মোটেই সত্য নয়।

অন্যদিকে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, শ্রমিক ও গ্রামীণ টেলিকম সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী গ্রামীণ টেলিকম কর্তৃপক্ষ ২০১০ থেকে ২০২১-২২ পর্যন্ত লভ্যাংশ ৪৩৭ কোটি ১ লাখ ১২ হাজার ৬২১ টাকা নির্ধারিত হিসাবে জমা করে। চুক্তি অনুযায়ী ওই অ্যাকাউন্ট থেকে সম্পূর্ণ টাকা গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক কর্মচারীদের প্রাপ্য হলেও ২৬ কোটি ২২ লাখ ৬ হাজার ৭৮০ টাকা গ্রামীণ টেলিকম এমপ্লোয়ি ইউনিয়নের হিসাবে জমা হয়। আর ওই অ্যাকাউন্টের সিগনেটরি ছিলেন গ্রামীণ টেলিকমের এমডি নাজমুল ইসলাম, গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মো. কামরুজ্জামান এবং সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদ হাসান। সে হিসাবে অর্থ আত্মসাতের দায় ওই তিনজনের ওপর পড়বে। আরও অনুসন্ধানে বিস্তারিত প্রমাণ পাওয়া যাবে।

যদিও গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল ইসলাম কোনো আত্মসাৎ হয়নি বলে দাবি করেছেন। নাজমুল বলেন, এখানে কোনো আত্মসাৎ হয়নি। শ্রমিক ইউনিয়নের হিসাবেই টাকা গিয়েছে। ৪৩৭ কোটি শ্রমিকরা দাবি করেছিল, সে টাকা তাদের দেওয়া হয়েছে। সব ব্যাখ্যা দুদককে দেওয়া হয়েছে। আমরা তাদের চাহিদাকৃত কাগজপত্র দিয়েছি, তারা তা দেখুক। এটা এক ধরনের ভুল বোঝাবুঝি বলতে পারেন।

আরও পড়ুন : মন্ত্রীর একান্ত সচিবের ব্যাংক হিসাবেই ৮ কোটি টাকা!

অন্যদিকে এ বিষয়ে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে শ্রমিক ও কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টনের জন্য সংরক্ষিত লভ্যাংশের ৫ শতাংশ অর্থ লোপাট, তাদের পাওনা পরিশোধকালে অবৈধভাবে অ্যাডভোকেট ফি ও অন্যান্য ফি’র নামে ৬ শতাংশ অর্থ কর্তনসহ কোম্পানি থেকে ২ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগে নোটিশ প্রদান করা হলে বৃহস্পতিবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন প্রতিনিধি মো. মাইনুল ইসলাম ডিবির কাছে গ্রেপ্তার আছেন। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা মনে করলে অভিযোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

গত ২২ আগস্ট ওই চারজনকে তলব করে চিঠি দিয়েছিল দুদক। গত ১৬ আগস্ট নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সংক্রান্ত ১১ ধরনের নথিপত্র সংগ্রহ করে দুদকের অনুসন্ধান টিম। অভিযোগ অনুসন্ধানে তিন সদস্যের টিম গঠন করে দুদক। টিমে দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনকে তদারককারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। টিমের অপর সদস্যরা হলেন, সহকারী পরিচালক জেসমিন আক্তার ও নূরে আলম সিদ্দিকী।

আরএম/এসকেডি