ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে চারদিনের সফরে সোমবার (৫ সেপ্টেম্বর) দিল্লি সফরে যাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি, খাদ্য নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন ধরনের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পাশাপাশি আগামী বছর বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন এবং পরবর্তী বছরে ভারতের নির্বাচন সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুকন্যার এ সফর ঘিরে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে চলছে নানা আলোচনা। চলছে নানা সমীকরণ বিশ্লেষণ।

প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফরের গুরুত্ব, প্রত্যাশা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ বিবেচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদের সঙ্গে আলাপ করেছে ঢাকা পোস্ট।

শেখ হাসিনার সফরের গুরুত্বের প্রশ্নে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, এ ধরনের সফরের একটা গুরুত্ব তো থাকবেই। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী যাচ্ছেন সেখানে গুরুত্ব না থাকার কোনো কারণ নেই। গুরুত্বের আরেকটা কারণ হচ্ছে, এ মহাদেশে শেখ হাসিনাই সবচেয়ে বয়জ্যেষ্ঠ নেতা। অনেকদিন ধরে তিনি প্রধানমন্ত্রী আছেন। আমরা যদি পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় দেখি এ রকম নেতা তো আর নাই বলতে গেলে। সে জায়গায় তার মূল্যায়ন এবং স্ট্যাটাস আগের চেয়ে অনেক অনেক বেড়েছে। 

তিনি বলেন, তার ওপরে যেভাবে করোনা মহামারি মোকাবিলা, বাংলাদেশের উন্নয়ন, বিশ্ব ব্যাংক সরে যাবার পরও পদ্মা সেতু বানিয়ে দেখিয়ে দেওয়া; এ বিষয়গুলোর কারণে তার অবস্থান তো অনেক ওপরে উঠেছে। তার আমলে জিডিপির পারক্যাপিটাল ইনকাম ভারতের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। এমনকি তার আমলে মাথাপিচু জিডিপির পরিমাণ ভারতের সঙ্গে তুলনা করা হয়। মানব উন্নয়ন সূচকের অনেক খাতে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। তার আমলেই বাংলাদেশকে রোল মডেল মনে হচ্ছে, সেখানে তার বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রে সফর নিয়ে গুরুত্ব অবশ্যই থাকবে।

সফরে কোন বিষয়টি বেশি গুরুত্বের দাবি রাখে— এমন প্রশ্নের জবাবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি ইস্যুকে ওপরে রাখছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এ অধ্যাপক। এ প্রসঙ্গে তার ভাষ্য, হঠাৎ করে বড় একটা ইস্যু হয়ে উঠেছে জ্বালানি নিরাপত্তা। আমি মনে করি, মূল বিষয় জ্বালানি নিরাপত্তা হওয়া উচিত। এটা নিয়ে বড় আকারে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। কারণ আমরা এখনও ক্রাইসিস থেকে উঠে আসতে পারিনি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যে নিষেধাজ্ঞা পশ্চিমা দেশ দিয়েছে, সেটা ভারত মানেনি। সেখানে বাংলাদেশ কিভাবে উপকৃত হতে পারে, কিভাবে সম্পর্ক তৈরি করতে পারে ভারতের সঙ্গে।

ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ভারত তো নিষেধাজ্ঞা না মেনেই রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ কেন পারবে না। তাছাড়া ভবিষ্যতে যদি ক্রাইসিস হয় সেটা সামাল দেওয়া যায় কীভাবে, সে ব্যাপারে দু’দেশের মধ্যে বড় ধরনের আলোচনা থাকবে বলে আমি মনে করি।

শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন মহলের আলোচনার মধ্যে রোববার (৪ সেপ্টেম্বর) প্রধানমন্ত্রীর সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সাংবাদিকরা এ সফরে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আলোচনার বিষয়ে জানতে চান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের কাছে। জবাবে মোমেন বলেন, নির্বাচনের আরও অনেক দিন বাকি। সুতরাং এটা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন নই।

একই প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, দিল্লি সফরে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কোনো আলোচনা হবে না। প্রতিমন্ত্রীর ভাষ্য, অবশ্যই বাংলাদেশের নির্বাচন অন্য কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার-প্রধানের সঙ্গে আলোচনার বিষয়বস্তু নয়।

রাজনৈতিক বিবেচনায় এবং নির্বাচন ইস্যু জানতে চাইলে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের ব্যাপারে দিল্লিতে একটা মত তৈরি হয়েছে। বিরোধী দল যখন ক্ষমতায় ছিল তখন নর্থইস্টে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড দেখা গেছে। সেখানে ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ আসাম (উলফা) থেকে শুরু থেকে ১০ ট্রাক অস্ত্রের ব্যাপারে সবাই অবগত আছে। যার কারণে দিল্লিতে কি কংগ্রেস বা বিজেপি তারা মনে করে আওয়ামী লীগ ওই অঞ্চলের ব্যাপারে সৎ থেকেছে। সেখানে সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে কোনো ছাড় বা জিরো টলারেন্স নীতিতে থেকেছে শেখ হাসিনার দল। যার কারণে দিল্লির যে মত সেটা পরিবর্তন হওয়ার কথা না।

ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, আমি বরারবই বলে এসেছি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এদেশের জনগণই ঠিক করে। বিশেষ করে বাংলাদেশের যারা স্টেক হোল্ডার। আন্তর্জাতিক এলিমেন্ট মাঝে মাঝে ক্রেডিট নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আসলে ঠিক করে বাংলাদেশি যারা স্টেক হোল্ডার আছে। যেমন-ব্যবসায়ী, ছাত্র, আমলা,মিলিটারি, পুশিল; এরা একটা বিরাট স্টেক হোল্ডার। শেষ বিচারে জনগণের একটা বিরাট ভূমিকা থাকে। সে জায়গায় আমি মনে করি না, দিল্লির সঙ্গে এ ব্যাপারে (নির্বাচন) আলোচনার কোনো সুযোগ আছে বা হওয়া প্রয়োজন। আমার মনে হয়, দিল্লির সফরে এ ধরনের বিষয় থাকবে না। বরং সেগুলো করতে গেলে আরও সমস্যার তৈরি হয়।

পানিবন্টন ইস্যুতে তিস্তার জট খোলা নিয়ে কোনো সমাধান হবে বলে মনে করছেন না অধ্যাপক ইমতিয়াজ। তার ভাষ্য মতে, যদি বড় কিছুর কথা বলি, যদি বড় কিছুর কথা বলা হয়, তিস্তা প্রসঙ্গ আসে। আমার মনে হয় না যে হতে যাচ্ছে। তবে হলে ভালো। বরং যেটা সমস্যা তৈরি করতে পারে, অন্য নদী নিয়ে যদি এগ্রিমেন্ট হয় তিস্তার দিকে না হয় তাহলে একটা সমালোচনা থাকবে।

ঝুলে থাকা তিস্তা নিয়ে ভিন্ন চিন্তার পরামর্শ দেন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এ অধ্যাপক। তিনি বলেন, ভারত পানি দিতে পারছে না শীতের মৌসুমে। তাহলে বৃষ্টির মৌসুমে যে পানিটা আসছে সেটাকে যদি ধারণ করা বা রাখা যায়, যেটা যদিও ভারতের পরিবেশগত ব্যয় এবং অর্থনৈতিক ব্যয় আছে। সেই অর্থনৈতিক ব্যয়ে চীনের দেখানো আগ্রহে অংশীদার যদি ভারত হয়, তাহলে সেখানে কিছুটা সমাধান হতে পারে। যেখানে ভারত, চীন, জাপান ও এশিয়ান ডেভলপমেন্ট মিলে কাজ করল। তাহলে ভারতও কিছুটা চিন্তামুক্ত থাকল। সেরকম বিষয়ে আমার মনে হয় আলোচনা সরাসরি করা দরকার। কারণ এ তিস্তা বছরের পর বছর ঝুলে আছে। এটার মূল সমস্যাটা হলো সিকিমে, একাধিক হাইড্রোড্যাম তৈরি করার ফলেই এ সমস্যা হচ্ছে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনার সুযোগ রয়েছে এবং ভারত চাইলে এ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে পারে জানিয়ে অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্ট করে বলেছে, রাখেইনে জেনোসাইট (গণহত্যা) হয়েছে। ভারত এখনও রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকছে। এ জায়গায় ভারত কোনো ভূমিকা রাখতে পারে কি-না, এটা নিয়ে আলোচনা দরকার। চায়নার ত্রিপক্ষীয় পদক্ষেপের কথা বলছে। চায়না যদি এটা করে, ভারতও করতে পারে। তিন দেশ নিয়ে একটা আলোচনা ভারত কেন পারবে না? দিল্লির সঙ্গে তো মিয়ানমারের সম্পর্ক ভালো, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো।

কমপ্রিহেনসিভ ইকোনোমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (সেপা) চুক্তির বিষয়ে রোববার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানান, সেপা বিশদ একটা বিষয়। এটা নিয়ে আলোচনা চলছে।

প্রধানমন্ত্রীর সফরে সেপা নিয়ে কোনো অগ্রগতি হতে পারে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে ইমতিয়াজ আহমেদের ভাষ্য, আমার মনে হয় না ভারত এত তাড়াতাড়ি সে ধরনের কোনো কাঠামোর মধ্যে যেতে চাইবে। আমাদের দিক থেকে হয়তো আগ্রহ রয়েছে। কিন্তু ভারত এত তাড়াতাড়ি এ রকম একটা বিষয়ে যাবে বলে মনে হয় না।

নর্থ-ইস্টের উন্নয়নের ব্যাপারে যদি বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের সুবিধা করে দেওয়া হয়, সেটা ভারতের ভারতের ব্যবসায়ীরা কতখানি তাদের সরকারকে এ ব্যাপারে হ্যাঁ বলবে এটা বলা মুশকিল। সেজন্য এ সফরে এ রকম কিছু হলে ভালো। হতে যাচ্ছে এ ধরণের নিশ্চয়তা আমি এখনও দেখতে পাচ্ছি না।

এনআই/এসএম