অনেক দিনের জমে থাকা ক্ষোভ, রাজনৈতিক বিরোধ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে খুন হন গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় সাত আসামির মধ্যে চন্দন ছিলেন সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-দপ্তর সম্পাদক। নানা অনিয়ম, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ, নারী নির্যাতন মামলার কারণে দল থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর থেকেই এমপি লিটনকে খুনে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন চন্দন।

রোববার (১১ সেপ্টেম্বর) রাতে সাতক্ষীরার ভোমরা এলাকা থেকে এমপি লিটন হত্যা মামলার প্রধান সমন্বয়কারী ও ইন্টারপোলের রেড এলার্ট জারি করা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি চন্দনকে গ্রেপ্তারের পর এসব তথ্য জানিয়েছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। 

সোমবার (১২ সেপ্টেম্বর) দুপুরে কারওয়ান বাজার র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল-মঈন এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ সংসদীয় আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল কাদের খানের পরিকল্পনাতে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। আবদুল কাদের খান ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সুন্দরগঞ্জ এলাকায় নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। 

সংসদ সদস্য থাকাকালীন বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার দুর্নীতির বিষয়ে মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন অভিযোগ উত্থাপন করেন। পরে ২০১৪ সালে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাইবান্ধা-১ আসন থেকে মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন তৎকালীন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়।

দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, রাজনৈতিক বিরোধ, আধিপত্য বিস্তার ও তৎকালীন সংসদ সদস্যকে সরিয়ে পুনরায় সংসদ সদস্য হওয়ার লোভে মূলত এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করে আবদুল কাদের খান।

২০১৬ সালে প্রথম দিকে এমপি লিটনকে হত্যার পরিকল্পনার বিষয়ে গ্রেপ্তার চন্দন কুমার রায়কে জানান আবদুল কাদের খান। চন্দন ও আবদুল কাদের খানের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের মাধ্যমে ২০১৬ সালে ৩১ ডিসেম্বর এমপি লিটনকে তার নিজ বাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয়।

নিহত লিটনের ছোট বোন বাদী হয়ে সুন্দরগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এই সংসদ সদস্যের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তখন দেশব্যাপী ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। হত্যা মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষে তদন্তকারী কর্মকর্তা ২০১৭ সালের ৩০ এপ্রিল মূল পরিকল্পনাকারী আবদুল কাদের খানসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। যার মধ্যে হত্যাকাণ্ডের প্রধান সমন্বয়কারী চন্দন কুমার রায় ছাড়া বাকি ৭ জন গ্রেপ্তার হয়।

পরে ২০১৯ সালের ২৮ নভেম্বর বিচার কার্যক্রম শেষে গ্রেপ্তার হওয়া ৬ জন এবং পলাতক আসামি চন্দনসহ ৭ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আদালত। অপর আসামি সুবল চন্দ্র কারাগারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। পলাতক চন্দন কুমার রায়কে গ্রেপ্তারে ইন্টারপোল থেকে রেড এলার্ট জারি করা হয়। 

কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেপ্তার চন্দন কুমার রায় সুন্দরগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহ-দপ্তর বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময় এমপি লিটনের সমর্থিত লোকজনের সঙ্গে তার মারামারির ঘটনা ঘটে এবং চন্দন গুরুতর আহত হয়। এমপি লিটনের প্ররোচনায় একই সময়ে একটি মামলার আসামি দেখিয়ে তাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার করে। ওই মামলায় চন্দন ১৯ দিন কারাভোগ করেন। 

তার বিরুদ্ধে থাকা চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতনসহ অন্যান্য মামলা থেকে অব্যাহতি পেতে তিনি এমপি লিটনের সহযোগিতা চান। কিন্তু এমপি লিটন তাকে আইনানুগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে বলায় তিনি লিটনের প্রতি ক্ষুব্ধ হন। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে দুর্নীতি, চাঁদাবাজির অভিযোগে ২০১৬ সালের প্রথমদিকে এমপি লিটন তাকে দলীয় পদ থেকে বহিষ্কার করেন। 

পরে আবদুল কাদের খানের পিএস ও এমপি লিটন হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সহযোগী শামসুজ্জোহার সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে আবদুল কাদের খান ও তার সখ্য তৈরি হয়। চন্দনের ভগ্নিপতি সুবল রায় এমপি লিটনের বাড়ির দারোয়ান হিসেবে কাজ করার সুবাদে নিত্যদিনের খবরাখবর জানা সহজ ছিল চন্দনের। 

এমপি লিটনকে হত্যাকাণ্ডের কয়েকটি পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ায় আবদুল কাদের খান চন্দনের সহযোগিতায় নতুন পরিকল্পনা করেন। এ ঘটনায় চন্দন প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। লিটনের গতিবিধি ও অবস্থান সম্পর্কে আবদুল কাদের খানসহ অন্যান্য সহযোগীদের তথ্য দিতেন চন্দন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, হত্যাকাণ্ডে তাদের সহযোগী মেহেদী, শাহীন, রানা, শামসুজ্জোহা, চালক হান্নান অস্ত্র চালানো ও হত্যাকাণ্ডের পর দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার প্রশিক্ষণ নেন।

২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে চন্দন এমপি লিটনের ঢাকা থেকে গাইবান্ধা আগমনের তথ্য দেয়। তারা মাঝপথে হত্যার পরিকল্পনা নিলেও এমপি লিটন গাবতলী এসে ফিরে যাওয়ায় তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।

পরে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে তারা এমপি লিটনকে তার নিজ বাড়িতেই হত্যার পরিকল্পনা করে। সে জন্য ঘটনার দিন ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর লিটনের চাচাতো ভাই সুবল এবং চন্দন বাড়িতে অবস্থান করে এবং এমপি লিটন কখন কী অবস্থায় থাকে এ সংক্রান্ত খোঁজখবর অন্যান্যদের দিতে থাকেন।

ওইদিন বিকেলে গ্রেপ্তার সুবল জানায়, এমপি লিটন তার নিজ বাড়িতে একা অবস্থান করছে। পরিকল্পনা মোতাবেক হত্যাকারী শাহীন, রানা ও মেহেদী মোটরসাইকেলে করে এমপি লিটনের বাড়িতে যায় এবং নৃশংসভাবে গুলি করে কিলিং মিশন শেষ করে। 

হত্যাকাণ্ডের পর জড়িত আবদুল কাদের খানসহ জড়িত ৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও চন্দন পার্শ্ববর্তী দেশে আত্মগোপনে চলে যায়।

চন্দন কুমার রায় সম্পর্কে কমান্ডার মঈন বলেন, ২০১০ সালের দিকে রাজধানীর একটি অনলাইন পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন তিনি। দুই বছর সাংবাদিকতা করার পর গাইবান্ধা ফিরে স্থানীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থানায় তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতনসহ বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। 

হত্যাকাণ্ডের পর চন্দন প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে যায় এবং নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে শাওন রায় নামে ভূয়া নাগরিকত্ব, আধার/রেশন কার্ড করে সেখানে অবস্থান করে। 

ভারতে অবস্থানকালীন রংপুর ও গাইবান্ধা সীমান্ত নিকটবর্তী অঞ্চল দিয়ে গাঁজা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদকের চালান বাংলাদেশে পাঠাতেন তিনি।

সম্প্রতি মাদক সংক্রান্ত কাজে তিনি সাতক্ষীরায় সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থান করছিলেন। পরে সাতক্ষীরা জেলার সীমান্তবর্তী ভোমরা এলাকা থেকে আটক করে র‌্যাব। মাদকের অর্থ সংগ্রহ, মাদকের ব্যবসা তদারকি এবং মাদক কারবারিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন সময়ে সে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। মাদক চোরাচালান সংক্রান্ত কার্যক্রম শেষে আবার ভারত চলে যাওয়ার আগেই গ্রেপ্তার করা হয় তাকে।

জেইউ/এসএম