বড় অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে ভারতীয় নাগরিক হাফেজ আহম্মেদকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দিয়ে অনুমোদিত চার্জশিটের চূড়ান্ত আসামি হলেন ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাত কর্মকর্তা ও কর্মচারী। যদিও বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে ইতোমধ্যে সৌদি আরবে পালিয়ে গেছেন সেই ভারতীয় নাগরিক।

তদন্ত কর্মকর্তা ও দুদক উপ-পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরীর সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান কার্যালয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হবে। মঙ্গলবার (১৩ সেপ্টেম্বর) দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

অনুমোদিত চার্জশিটের আসামিরা হলেন, পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মো. আবজাউল আলম, সাময়িক বরখাস্ত হওয়া অফিস সহায়ক রঞ্জু লাল সরকার ও হুমায়ুন কবির, রাজশাহী পাসপোর্ট অফিসের সাবেক উচ্চমান সহকারী ও আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের সুপারিনটেনডেন্ট মো. দেলোয়ার হোসেন, ডাটা এন্ট্রি কন্ট্রোল অপারেটর আলমাস উদ্দিন, রেকর্ড কিপার মো. ইব্রাহিম হোসেন ও সাঁট মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর মো. আব্দুল ওয়াদুদ। এজাহারভুক্ত প্রধান আসামি ভারতীয় নাগরিক হাফেজ আহম্মেদ ইতোমধ্যে সৌদি আরব চলে গেছেন। তার সঠিক ঠিকানা জানা যায়নি। তাই অপরাধ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও তাকে চার্জশিটে রাখা হয়নি। তবে ভবিষ্যতে তার নাম ঠিকানা প্রাপ্তি সাপেক্ষে সম্পূরক চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে অনুমোদিত চার্জশিটে বলা হয়েছে।

আরও পড়ুন : ৬৯ পাসপোর্ট অফিস থেকে ওঠে কোটি কোটি টাকার মাসোহারা!

২০২০ সালের ১১ মার্চ দুদকের রাজশাহী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে একটি মামলা দায়ের করা হয়। এরপরই উপ-পরিচালক মো. মামুনুর রশীদ চৌধুরীকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

দুদকের তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ভারতীয় নাগরিক হাফেজ আহম্মেদের নামে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ইস্যু এবং তাকে সৌদি আরব গমনে সহায়তা সংক্রান্ত একটি অভিযোগ জমা পড়ে দুদকে। কমিশন অভিযোগটি অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দুদক উপ-পরিচালক মো. আবু বকর সিদ্দিককে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির অপর সদস্য ছিলেন সহকারী পরিচালক (বর্তমানে উপ-পরিচালক) মো. মামুনুর রশীদ চৌধুরী ও উপ-সহকারী পরিচালক (বর্তমানে সহকারী পরিচালক) আফনান জান্নাত কেয়া।

ঘটনার বিবরণে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৭ সালের ৬ জুন ভারতীয় নাগরিক হাফেজ আহম্মেদ রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার সাপুরা ডাকঘরের ছোট বনগ্রামের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে পাসপোর্ট ইস্যুর জন্য রাজশাহী বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে অনলাইনে আবেদন করেন। পাসপোর্ট অফিসের অফিস সহায়ক রঞ্জু লাল সরকার আবেদনপত্রটি অফিসিয়ালি জমা দেখিয়ে নিজ হেফাজতে রাখেন। এরপর রঞ্জু লাল সরকার তার পরিচিত ট্রাভেল এজেন্সির মালিক গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পাসপোর্টের আবেদনপত্র জমা থেকে শুরু করে পাসপোর্ট প্রদান পর্যন্ত সব কাজ সম্পন্ন করতে অবৈধ লেনদেনে চুক্তিবদ্ধ হন তারা। পরে রঞ্জু লাল সরকার রাজশাহী সিটি করপোরেশনের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর মো. নূরুল ইসলাম রাজুর মাধ্যমে জন্মসনদ তৈরি করেন। ২০১৭ সালের ১৩ জুন ট্রাস্ট ব্যাংকের মাধ্যমে পাসপোর্ট ফি-বাবদ তিন হাজার ৪৫০ টাকা পরিশোধ করা হয় এবং ২০১৭ সালের ৯ জুলাই পাসপোর্টের উচ্চমান সহকারী মো. দেলোয়ার হোসেনের নিকট আবেদনপত্রটি উপস্থাপন করা হয়। তার অনুমোদনের পর আবেদনপত্রটি অন্যান্য আবেদনপত্রের ন্যায় একই তারিখে বায়ো-এনরোলমেন্ট কার্যক্রম সম্পন্ন না করে ১২ জুলাই তা সম্পন্ন করা হয়। ২০১৭ সালের ৩১ জুলাই বাংলাদেশ পুলিশের রাজশাহী সিটি স্পেশাল ব্রাঞ্চের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট আবেদনসহ মোট ৪৩টি আবেদনের বিষয়ে পুলিশ প্রতিবেদন পাঠানো হয়। পুলিশ প্রতিবেদনে আবেদনকারী হাফেজ আহম্মেদকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

কিন্তু স্পেশাল ব্রাঞ্চের মডিউলের দায়িত্বপ্রাপ্ত পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারী আসামি মো. হুমায়ুন কবির অসৎ উদ্দেশ্যে বিষয়টি কম্পিউটার সিস্টেমে ইনপুট দেননি। ফলে ১৮ আগস্ট আবেদনপত্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে অ্যাপ্রুভাল মডিউলে চলে যায়। রাজশাহী বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মো. আবজাউল আলম তার দাপ্তরিক বিভিন্ন কাজে সহায়তাকারী ডাটা এন্ট্রি কন্ট্রোল অপারেটর আলমাস উদ্দিনের মাধ্যমে ৩০ আগস্ট ডাটা কারেকশন (ঠিকানা- বাড়ির নম্বর সংশোধন) করে পাসপোর্ট প্রদানের চূড়ান্ত অনুমোদন দেন।

আরও পড়ুন : পাসপোর্ট করার আগে সংশোধন করতে হবে এনআইডি

এরপর আসামি রঞ্জু লাল সরকার ৭ সেপ্টেম্বর সকালে তৎকালীন রেকর্ড কিপার আসামি মো. ইব্রাহিম হোসেনের (ইউজার আইডি ব্যবহার করে) সহযোগিতায় পাসপোর্ট (নম্বর- বিকিউ ০১৭৮২৬০) ডেলিভারি করিয়ে নেন। ওই পাসপোর্ট ব্যবহার করে ভারতীয় নাগরিক হাফেজ আহম্মেদ ২০১৮ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ বিমানের বিজি-০০৩৫ ফ্লাইটে সৌদি আরবে যান। হাফেজ আহম্মেদ দেশছাড়ার পর তার আবেদনের মূল রেকর্ডপত্র রাজশাহী পাসপোর্ট অফিস থেকে বিনষ্ট ও গায়েব করা হয়।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভারতীয় নাগরিক হাফেজ আহম্মেদের বিপক্ষে আসা পুলিশ প্রতিবেদন গোপন করে আসামিরা অন্যায়ভাবে লাভবান হওয়ার জন্য পরস্পর যোগসাজশে প্রতারণা, জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে পাসপোর্ট তৈরি, ইস্যু ও বিতরণসহ যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করে সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র বিনষ্ট ও গায়েব করে দণ্ডবিধি ৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/২০১/১০৯ ধারা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন- ১৯৪৭ এর ৫ (২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

আরএম/এসকেডি