আগে দিনে একবার গ্যাস নিলে সারা দিন চলে যেত। এখন দিনে দুই বার গ্যাস নিয়েও সিলিন্ডার ভরছে না। ঢাকা শহরে সিএনজি চালিয়ে প্রতিদিন দুই বার লাইনে দাঁড়িয়ে গ্যাস নিলে তো আমাদের চলবে না। এখন তো সারা দিন চলে যায় গ্যাসের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে, গাড়িতে যাত্রী কখন উঠাব।

বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর) সকালে গ্যাসের সংকটের কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করে এসব কথা বলেন সিএনজি অটোরিকশাচালক মো. জাহাঙ্গীর।

গত দুই সপ্তাহে রাজধানীর সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোতে গ্যাসের চাপ কম থাকায় ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছেন না চালকরা।

সিএনজিচালক মো. জাহাঙ্গীর বলেন, আমাদের সিএনজি অটোরিকশার সিলিন্ডার ৩০০ টাকার গ্যাসে ভরে যায়। কিন্তু গত দুই সপ্তাহ ধরে ১২০ টাকার বেশি গ্যাস নেওয়া যাচ্ছে না। যতবারই আসি পাম্পে, শুনি গ্যাসের চাপ কম। আগে যেখানে একবার গ্যাস নিলে সারাদিন চলে যেত, এখন সেখানে দিনে দুই-তিন বার নিতে হয়। আর লাইনে দাঁড়াতে হয় দুই-তিন ঘণ্টা। এখন তো গ্যাস নিতেই সারাদিন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, যাত্রী আর কখন তুলব। এ অবস্থা চলতে থাকলে গাড়ির জমাও দিতে পারব না, নিজেকেও না খায়ে থাকতে হবে।

আরও পড়ুন: সড়কে আইন অমান্য করলেই ডাকবে, শেখাবে, বোঝাবে ট্রাফিক পুলিশ

জানা গেছে, রাজধানীর প্রগতি সরণি এলাকার চারটি সিএনজি ফিলিং স্টেশনের মধ্যে গ্যাসের ন্যূনতম চাপ রয়েছে এসটি পাওয়ার লিমিটেড নামের একটি সিএনজি ফিলিং স্টেশনে। বাকিগুলোতে গ্যাস বিক্রি বন্ধ রয়েছে।

এসটি পাওয়ারের ঠিক উল্টো পাশে অবস্থিত মক্কা সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, স্টেশনটিতে গ্যাসের চাপ নেই। তাই গ্যাস নিতে আসা গাড়ির চালকরা ফিরে যাচ্ছেন।

এ বিষয়ে স্টেশনটির বিক্রয় কর্মী আতিক জানান, এক সপ্তাহ ধরে গ্যাসের চাপ না থাকায় তারা পাম্পের মেশিন বন্ধ রেখেছে। গ্যাসের চাপ ঠিক না হওয়া পর্যন্ত তারা মেশিন চালু করবেন না।

উত্তর বাড্ডায় অবস্থিত এসটি পাওয়ার লিমিটেড নামের রিফুয়েলিং স্টেশনে সরেজমিনে দেখা যায়, গ্যাসের জন্য অপেক্ষমাণ গাড়ির দীর্ঘ লাইন স্টেশন থেকে শাহাজাদপুরের সুভাস্তু টাওয়ার পর্যন্ত পৌঁছেছে। এতে কুড়িল বিশ্বরোড-রামপুরা রোডের শাহজাদপুর অংশের একাংশ দখল হয়ে আছে। ফলে রাস্তায় যান চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে, যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।

কিন্তু দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়িয়েও চাহিদা মতো গ্যাস পাচ্ছেন না চালকরা। চাহিদা মতো গ্যাস না পেয়ে ও দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে চালকরা ভোগান্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন।

ওই সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনে গ্যাস নিতে আসা চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গেল দুই সপ্তাহ ধরে তারা গ্যাসের চাপ না থাকায় সীমাহীন ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে তাদের নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। কষ্ট করে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পরও যখন চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছেন তখন চালকদের ভোগান্তি আরও কয়েক গুণ বেড়ে যাচ্ছে।

এসটি পাওয়ার সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনে গ্যাস নিতে সুভাস্তু টাওয়ারের সামনে লাইনে দাঁড়িয়েছেন প্রাইভেটকার চালক মো. গোলাপ। তিনি বলেন, সকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছি। লাইন সামনে এগোচ্ছে না। গত দুই সপ্তাহ ধরে এ অবস্থা চলছে সিএনজি স্টেশনগুলোতে। কুড়িল থেকে এ পর্যন্ত তিন-চারটি সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন রয়েছে। এর দুইটা ঘুরে এসেছি, গ্যাস নাই। এখানে দিচ্ছে শুনে এসেছি। কিন্তু এখানেও লম্বা লাইন এগোচ্ছে না।

তিনি বলেন, আমার গাড়ির সিলিন্ডার পূর্ণ হতে সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকার গ্যাস প্রয়োজন। কিন্তু পাব মাত্র ১৫০-২০০ টাকার গ্যাস। এতে তো সারাদিন চলবে না। আবার বিকেলের দিকে লাইনে দাঁড়াতে হবে দুই-তিন ঘণ্টা গ্যাসের জন্য।

একই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা পিকআপ ভ্যানের চালক আনোয়ার মিয়া বলেন, রাস্তায় লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, মাঝে মধ্যে ট্রাফিক পুলিশ এসে বলছে রাস্তা ছাড়তে। রাস্তায় যানজট হচ্ছে। এই লাইনও সামনে এগোচ্ছে না। এসব সমস্যার কারণে গত দুই সপ্তাহ ধরে আমাদের গ্যাস নিতে আসতে দিনে দুই-তিন বার।

শুধু চালকরাই নয়, গ্যাসের চাপ কম থাকায় বিড়ম্বনায় আছেন রিফুয়েলিং কর্তৃপক্ষও। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্যাস না থাকার কারণে একদিকে যেমন তাদের বিক্রি কমেছে, তেমনি স্টেশনে প্রতিদিন সৃষ্টি হতে থাকা লম্বা লাইন নিয়ন্ত্রণে আনতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

এসটি পাওয়ার লিমিটেড রিফুয়েলিং স্টেশনের বিক্রয় কর্মী মো. মিন্টু বলেন, গত দুই সপ্তাহ ধরে গ্যাসের চাপের এ অবস্থা চলছে। বিষয়টি আমরা তিতাসকে জানাই। তারা এসে গ্যাসের পাইপ পরীক্ষা করে চলে যায়। কিন্তু সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। তারা বলেও যায়নি যে কি কারণে গ্যাসের চাপ কমে গেছে। আমরা বিভিন্নভাবে শুনেছি, লাইনে গ্যাসের সংকট রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, গ্যাসের চাপ না থাকায় আমাদের নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। আগে যেখানে প্রতিদিন ২ লাখ ৫০ হাজার টাকার গ্যাস বিক্রি করা যেত এখন তা নেমে এসেছে ১ লাখে। কখন এ সমস্যার সমাধান হবে তাও আমরা জানি না।

রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় অবস্থিত জামান সিএনজি ফিলিং স্টেশনের মালিক মোন্তাকা জামান কাপ্পি ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত দুই সপ্তাহ ধরে সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৩-৪টা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ কম থাকে। বলতে গেলে সারাদিন গ্যাসের চাপ কম। দিনের বেলা হচ্ছে ব্যবসার আসল সময়। কেন গ্যাসের চাপ কম তা আমাদের কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না।

এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির জরুরি গ্যাস নিয়ন্ত্রণ শাখার (দক্ষিণ) ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. শবিউল আওয়াল ঢাকা পোস্টকে বলেন, জাতীয়ভাবে আমাদের গ্যাস সরবরাহ কম, এটা এখন জাতীয় সমস্যা৷ এ সমস্যা কবে নাগাদ সমাধান হবে আমরা জানি না। সমস্যার সমাধান উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে।

তিনি বলেন, আমাদের সরবরাহের বিষয়টি নির্ভর করে দেশীয় উৎপাদন ও আমদানির ওপর। কিন্তু গত আড়াই মাস ধরে দেশে এলএনজি আমদানি বন্ধ রয়েছে। যার ফলে এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে। আমরা যতটুক জানতে পেরেছি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বৃদ্ধির কারণে আমদানি বন্ধ রয়েছে। আমদানি কখন শুরু হবে আমরা বলতে পারব না। এটা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত।

এমএসি/এসএসএইচ