দীর্ঘদিন ধরেই বিশেষায়িত শিশু হাসপাতালের দাবি করে আসছিল রংপুরবাসী। সেই দাবির প্রেক্ষিতে নগরীর সদর হাসপাতালের প্রায় দুই একর জমির ওপর অত্যাধুনিক শিশু হাসপাতালের অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। আড়াই বছর আগে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট এ হাসপাতালটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হস্তান্তর করলেও এখনো সেখানে শুরু হয়নি চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম। জনবল নিয়োগ না হওয়ায় রংপুর বিভাগের দীর্ঘ প্রত্যাশার এই চিকিৎসালয় এখন নিজেই যেন ‘অসুস্থ’।
 
স্থানীয় সচেতন নাগরিকরা বলছেন, রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার নাজুক অবস্থা চলছে। দুই কোটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবার এই প্রতিষ্ঠানটি এখন আস্থাহীনতায় ভুগছে। বিশেষ করে হাসপাতালটিতে জনবল সংকট থাকায় শিশু বিভাগে চাহিদা মতো বিশেষজ্ঞদের দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে বিভাগীয় এই নগরীতে একটি বিশেষায়িত পূর্ণাঙ্গ শিশু হাসপাতাল গড়ার দাবিতে আন্দোলন করছেন তারা। বর্তমান সরকার ১০০ শয্যাবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ শিশু হাসপাতাল নির্মাণ করে দিয়েছেন। কিন্তু আড়াই বছরেও সেখানে শিশুদের চিকিৎসাসেবায় কোনো কার্যক্রম শুরু না হওয়াতে এখন তারা হতাশ।

এদিকে রংপুরের স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, রংপুরের সাবেক সদর হাসপাতালের ১ দশমিক ৭৮ একর জমির মধ্যে শিশু হাসপাতাল নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়া হয় ২০১৭ সালের ২১ নভেম্বর। ৩১ কোটি ৪৮ লাখ ৯২ হাজার ৮০৯ টাকা মূল্যের সেই কাজটি করেছেন ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মল্লিক এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স অণিক ট্রেডিং করপোরেশন। ভবন নির্মাণের জন্য দুই বছরের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হলেও নির্ধারিত সময়ের আড়াই মাস আগে কাজ শেষ করে ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

তিন তলা মূল হাসপাতাল ভবনের প্রতি তলার আয়তন ২০ হাজার ৮৮২ দশমিক ৯৭ বর্গফুট। এছাড়া নির্মাণ করা হয়েছে চার তলা ভিত্তির তিন তলা সুপারিনটেনডেন্ট কোয়ার্টার। সিঁড়ি বাদে প্রতি তলার আয়তন দেড় হাজার বর্গফুট। ছয় তলা ডক্টরস কোয়ার্টারের নিচতলায় গাড়ি পার্কিং, দ্বিতীয় তলা থেকে ডাবল ইউনিট। আছে ছয় তলা বিশিষ্ট স্টাফ অ্যান্ড নার্স কোয়ার্টার। দুই তলা বিশিষ্ট গ্যারেজ কাম ড্রাইভার কোয়ার্টার। নিচে দুটি গাড়ি রাখার ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে। বিদ্যুৎ সাবস্টেশন স্থাপনের জন্যও নির্মাণ করা হয়েছে একটি ভবন।  

শিশু হাসপাতালের মূল ভবনের ১ম তলায় থাকবে ইমার্জেন্সি, আউটডোর, চিকিৎসকদের চেম্বার এবং ল্যাব। দ্বিতীয় তলায় অপারেশন থিয়েটার, ব্রোন ইউনিট এবং ৩য় তলায় ওয়ার্ড এবং কেবিন থাকবে। নবনির্মিত এই হাসপাতাল ভবনটি আনুষ্ঠানিকভাবে জেলা সিভিল সার্জনকে ২০২০ সালের ৮ মার্চ হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু ওই বছরে করোনা প্রাদুর্ভাব বাড়ায় ভবনটিকে ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এখন সেখানে করোনা রোগীরদের চাপ নেই। এ কারণে কাঙিক্ষত ১০০ শয্যাবিশিষ্ট এই শিশু হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ সেবা শুরুর দাবি জানিয়েছে রংপুরবাসী।

হাসপাতালটি চালু হলে শিশুদের জটিল সার্জারিসহ সাধারণ সব রোগের চিকিৎসা স্বল্পমূল্যেই দেওয়া যাবে এবং ভোগান্তি কমে আসবে বলে মনে করেন সমাজ পরিবর্তন ও উন্নয়ন ফোরাম রংপুরের সংগঠক সাব্বির মোস্তফা পিয়াল। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বহু বছর ধরে পুরাতন সদর হাসপাতাল প্রাঙ্গণে একটি পূর্ণাঙ্গ শিশু হাসপাতাল নির্মাণের জন্য রংপুরের মানুষ আন্দোলন করেছে। বিভিন্ন সময়ে এই দাবিটি সরকারের নজরে আনতে আমরা চেষ্টা করেছি। বর্তমান সরকার আমাদের সেই দাবি পূরণে সদর হাসপাতালের জমিতে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট শিশু হাসপাতাল ভবন নির্মাণ করেছে । কিন্তু ভবন হস্তান্তরের আড়াই বছরেও সেখানে শিশুদের চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম শুরু করা তো দূরের কথা, লোকবলই নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। এটি এখানকার স্বাস্থ্য বিভাগের ব্যর্থতা। আমরা চাই দ্রুত সময়ের মধ্যে শিশু হাসপাতালে সেবা কার্যক্রম শুরু করা হোক।

সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) রংপুরের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সদরুল আলম দুলু ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনা মহামারিতে শিশু হাসপাতালটি করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। তখন মহামারি আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। ওই পরিস্থিতিতে সেটি নিয়ে কারো কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু এখন তো করোনা আক্রান্তের হার অনেক কমেছে। তাছাড়া বর্তমানে অনেক হাসপাতালেই করোনা আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা মনে করি কয়েকজন রোগীর জন্য পুরো শিশু হাসপাতালটি এভাবে ফেলে রাখলে তা পরিত্যক্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দ্রুত জনবল নিয়োগ দিয়ে রংপুরবাসীর দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল হিসেবে নির্মিত ১০০ শয্যার এই শিশু হাসপাতালটিতে সেবা কার্যক্রম চালু এখন সময়ের দাবি। এখানে শিশুদের চিকিৎসাসেবার কাজ শুরু করা অতিজরুরি হয়ে পড়েছে। কেননা এ অঞ্চলের সবচেয়ে বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। সরকারি হাসপাতালে কম খরচে সুচিকিৎসা পেলে তাদের অর্থ সাশ্রয় হবে।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক সহকারী পরিচালক ডা. শাহ্ মো. রফিকুজ্জামান বলেন, রংপুর বিভাগে পূর্ণাঙ্গ শিশু হাসপাতাল খুবই জরুরি। তবে এ কথাও সত্য যে করোনা বেড়ে যাওয়ায় শুরুতে ভবনটিকে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। এখন অবশ্য করোনার প্রকোপ কমে এসেছে। তাই শিশু হাসপাতালে জনবল নিয়োগ দিয়ে দ্রুত সেখানে শিশুসেবা কার্যক্রম শুরু করা উচিত।

শিশু ও নিউরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. অধ্যাপক এম এ ওয়াহেদ বলেন, রমেক হাসপাতালে একটি মাত্র শিশু বিভাগ দিয়ে এ অঞ্চলের চিকিৎসা প্রত্যাশী শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে নতুন পূর্ণাঙ্গ শিশু হাসপাতালটির কার্যক্রম শুরু করা উচিত। এটি চালু হলে শিশুদের জটিল সার্জারি ও সাধারণ রোগের চিকিৎসা স্বল্পমূল্যে প্রদান করা সম্ভব হবে। শিশুদের চিকিৎসা বাবদ অভিভাবকদের আর্থিক খরচ ও ভোগান্তি কমবে। পাশাপাশি চিকিৎসার জন্য ঢাকা অথবা পার্শ্ববর্তী দেশে যাওয়ার প্রবণতাও অনেকাংশে কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।

নবনির্মিত ১০০ শয্যাবিশিষ্ট শিশু হাসপাতালটির কার্যক্রম শুরু করার জন্য একটি কমিটি রয়েছে। সেখানে পদাধিকার বলে রমেক হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. শরীফুল আলম আহ্বায়ক ও রংপুর জেলা সিভিল সার্জন ডা. শামীম আহমেদকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। 

ওই কমিটির সদস্য রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. আবু মো. জাকিরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানান, শিশু হাসপাতালের বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সভা ডাকতে তিনি কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবকে অনুরোধ করবেন।

এ বিয়য়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. শরীফুল আলম বলেন, কিছুদিন হয়েছে রংপুরে যোগদান করেছি। এখনো অনেক কিছু অজানা। একটু সময় প্রয়োজন। শিশু হাসপাতালটি চালুর আগে সেখানে জনবল নিয়োগ দেওয়া দরকার। কতজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও কোন কোন বিষয়ে পারদর্শী চিকিৎসক এবং কতজন নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রয়োজন তা নির্ণয় করা কঠিন ও সময়সাপেক্ষ। কমিটির সবাইকে নিয়ে শিশু বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দ্রুত জনবল নিয়োগসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি জানাবেন বলেও জানান তিনি।  

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর