মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচার চক্রের প্রধান অভিযুক্তসহ ৪ জনকে আটক করেছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব-৩)। আটকরা হলেন- তোফায়েল আহমেদ (২৮), মো. আক্তার হোসেন (৩৮), মো. আনিছুর রহমান (৩৬) ও মো. রাসেল (৩০)।

সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) ভোরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম ও রাজধানীর গুলশান এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে থেকে ১৬টি পাসপোর্ট, ৩টি চেক বই, ৪টি স্ট্যাম্প, ৫টি মোবাইল ফোন, ৪টি বিএমইটি কার্ড ও ৪টি রেজিস্টার জব্দ করা হয়।

র‍্যাব জানায়, এসএসসি পাস তোফায়েল আহমেদ ২০১৭ সালে দুবাই যায়। সেখানের ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ায় তার বাবার হোটেলের ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। করোনার সময় তিনি দুবাই থেকে দেশে ফিরে আসেন। ওই সময় উপার্জন না থাকায় পরিচিত দুবাই প্রবাসী জাহিদের মাধ্যমে মানবপাচারে জড়িয়ে পড়েন তোফায়েল। নিজ এলাকা কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে একটি ট্রাভেল এজেন্সি চালু করেন। তবে ওই এজেন্সির কোনো লাইসেন্স বা বৈধ কোনো অনুমোদন ছিল না। শুধু সিটি করপোরেশন থেকে লাইসেন্স নিয়ে রাজধানীর গুলশান ও পল্টনে গড়ে তোলেন মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে মানবপাচারকারী একটি সিন্ডিকেট। সেখানে বিদেশ গমনেচ্ছুক অসংখ্য ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয় এই সিন্ডিকেট।

সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‍্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লেফট্যানেন্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, পরে জাহিদের মাধ্যমে আনিছুর ও আক্তারের সঙ্গে পরিচয় হয় তোফায়েলের। তাদের মাধ্যমেই রাসেলসহ অন্যান্য দালালদের সঙ্গে তোফায়েলের পরিচয় হয়। জাহিদ দুবাই থেকে ভ্রমণ ভিসা তৈরিতে এই চক্রকে সহায়তা করত। এদিকে তোফায়েল নিয়মিত দুবাই আসা যাওয়া করে থাকেন। সর্বশেষ এ বছরের আগস্টে দুবাই গিয়ে সেপ্টেম্বরে আবার দেশে ফেরেন।

প্রাথমিক অনুসন্ধান ও আটক আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে তিনি বলেন, চক্রের মূল অভিযুক্ত দুবাই প্রবাসী তোফায়েল আহমেদ এবং দেশে এ চক্রের অন্যতম হোতা আনিছুর রহমান ও আক্তার হোসেন (৩৮)। এছাড়াও রাসেল হচ্ছে তাদের অন্যতম সহযোগী। তারা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উচ্চ বেতনে বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি দেওয়ার নামে ভুক্তভোগী ও তাদের অভিভাবকদের প্রলুব্ধ করে। মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর খরচ বাবদ প্রাথমিকভাবে চক্রটি ৪-৫ লাখ টাকা নিয়ে থাকে। এছাড়াও ইউরোপ ও এশিয়ার অন্যান্য দেশে পাঠানোর জন্য তারা ৬-৮ লাখ টাকা নিয়ে থাকে।

তিনি আরও বলেন, এই চক্রের প্রলোভনে পড়ে ভুক্তভোগী ও তাদের অভিভাবকরা রাজি হলে প্রথমে তারা পাসপোর্ট ও প্রাথমিক খরচ বাবদ ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা নেয়। তারপর ভুক্তভোগী ও অভিভাবকদের বিদেশ থেকে বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে ফোন দিয়ে ভালো আছে বলে আশ্বস্ত করত। এতে ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা আরও বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পরিবহন খরচ, ভিসা খরচ, মেডিকেল খরচ, বিএমইটি ক্লিয়ারেন্স ইত্যাদি খরচের কথা বলে চক্রটি ধাপে ধাপে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে টাকা আত্মসাৎ করতে থাকেন। এরপর বিদেশে ফ্লাইটের দিন বিমানবন্দরে প্রবেশ গেটে ভুক্তভোগীদের কাছে তাদের পাসপোর্ট, ভিসা ও টিকেট হস্তান্তর করা হয়। বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে যাওয়ার পর ভুক্তভোগীরা বুঝতে পারেন তাকে ভ্রমণ ভিসায় বিদেশ পাঠানো হচ্ছে। তখন আসামিদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা ছাড়া ভুক্তভোগীদের কিছুই করার থাকে না। আসামিরা তখন আশ্বস্ত করে বিদেশ যাওয়ার পর তাদের ওয়ার্কিং ভিসা করে দেওয়া হবে।

তিনি বলেন, দুবাই পৌঁছার পর দুবাই প্রবাসী জাহিদ ভুক্তভোগীদের স্বাগত জানিয়ে একটি অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। তারপর ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে তাদের পাসপোর্ট ও নগদ অর্থ ছিনিয়ে নেওয়া হতো। তারপর তাদেরকে একটি সাজানো কোম্পানিতে চাকরি দেওয়া হয়। চার-পাঁচ দিন পর ওই কোম্পানি থেকে জানিয়ে দেওয়া হয় আইনি জটিলতার কারণে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।

র‍্যাব-৩ এর অধিনায়ক বলেন, তারপর জাহিদ পুনরায় ভুক্তভোগীদের অজ্ঞাত স্থানে বন্দি করে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে অর্থ আদায় করতেন। এ সময়ে ভুক্তভোগীদের কোনো খাবার দেওয়া হতো না। খাবার চাইলে জাহিদ বাংলাদেশ থেকে টাকা নিয়ে এসে খাবার কিনতে বলতেন। এ সময়ে তোফায়েলের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি ভুক্তভোগীদের অপেক্ষা করতে বলতেন। তিনি জানাতেন, আইনি জটিলতা দূর হলেই আবার কোম্পানি চালু হবে। তখন তারা বেতন ও কাজের সুযোগ পাবেন। এ সময়ে ভিকটিমরা নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অনেকে নিজেদের চেষ্টায় টিকেট জোগাড় করে দেশে আশার চেষ্টা করতেন। তখন জাহিদের নিকট থেকে পাসপোর্ট ফেরত নিতে হলে ভুক্তভোগীদেরকে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হতো।

লেফট্যানেন্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, আটক আসামিদের ট্রাভেল এজেন্সি বা রিক্রুটিং এজেন্সি পরিচালনার কোনো লাইসেন্স নেই। শুধুমাত্র সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে সিটি এক্সপ্রেস ট্রাভেল এজেন্সি নামে মানবপাচার করছিলেন। স্বল্প সময়ে, বিনাশ্রমে অধিক লাভ বা অর্থ উপার্জনই তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল।

আটক আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানান তিনি।

এমএসি/ওএফ