রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত এলাকা গুলিস্তান। ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাক আর যানজট ওই এলাকার নিত্যদিনের চিত্র। ওই এলাকায় দীর্ঘদিন অযত্নে-অবহেলায় পড়েছিল শহীদ মতিউর পার্ক। সংস্কারের পর পার্কটি মানুষকে সবুজের মাঝে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দিয়েছে।

সরেজমিন দেখা যায়, একসময়ের অবহেলিত পার্কটি সেজেছে নতুন রূপে। এখানে রয়েছে শতবর্ষী অনেক বৃক্ষ। যেগুলোর নিচে বসে মানুষ ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করছেন। সবুজের ছোঁয়ায় ফেলছেন স্বস্তির নিশ্বাস। পার্কের ভেতরে রয়েছে বাগানবিলাস গাঁদাসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফুল গাছ। এছাড়াও রয়েছে আম, জাম, ঝাউ, মেহগনি, দেবদারু, গাব, পাতাবাহার, একাশিয়া, ইউক্যালিপটাস, বকুলসহ নানা প্রজাতির গাছগাছালি।

দর্শানর্থীদের বিনোদনের জন্য পার্কের ভেতরে রয়েছে নাগরদোলা, হেলিকপ্টার, ট্রেন, পুকুরে আছে প্যারেড বোট, বাচ্চাদের সিলিভার, ভূতের ঘর, সুইমিং পুল, খাবারের জন্য আছে ক্যান্টিন, রয়েছে ব্যায়ামাগার ও গাড়ি পার্কিংয়ের নির্দিষ্ট স্থান।

পার্কে প্রবেশ ফি ১০ টাকা। আর প্রতিটি রাইডের জন্য দিতে হয় ৩০ টাকা। পার্কের ভেতরে পুকুরের দৃশ্য উপভোগ করতে তৈরি করা হয়েছে একটি বসার জায়গা। পুকুরের চারদিকের পাড় বাঁধাই করা। পুকুরে রয়েছে একটি দৃষ্টিনন্দন ঘাট। পার্কে বিভিন্ন রঙের বাতিও যুক্ত করায় সৌন্দর্য বেড়েছে। এছাড়া আছে দোতলা ব্যায়ামাগার। ব্যায়াম করার জন্য সব ধরনের সরঞ্জাম রয়েছে সেখানে। ভবনটির ভেতর থেকে দুই দিকের দৃশ্য উপভোগ করা যায়।

পার্কে ঘুরতে আসা সালেহা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি দুই ছেলেকে নিয়ে ঘুরতে এসেছি যাত্রাবাড়ী থেকে। ছুটির দিন তাই বাচ্চাদের নিয়ে আসতে পেরেছি। এখানে শিশুদের বিনোদনের জন্য বিভিন্ন রাইড রয়েছে। শিশুরাও আনন্দ পাচ্ছে। বাসার কাছে খরচও একটু কম, তাই এখানে এসেছি। পার্কটি সংস্কারের পর এখানে পরিচ্ছন্নতা এসেছে। যখন উন্মুক্ত ছিল তখন তো পরিবেশ ভালো ছিল না। এটি তখন নেশাগ্রস্থদের দখলে থাকত।

বিশ্রাম নেওয়া গুলিস্তান ফুটপাতের ব্যবসায়ী আবদুল হক ঢাকা পোস্টকে জানান, আগে প্রবেশের জন্য টাকা লাগত না, এখন ১০ টাকা লাগে। সারা দিনের ক্লান্তির পর এখানে এসে বসেছি। বিশ্রাম নিচ্ছি, ভালো লগছে। পুকুর পাড়ে অনেক বাতাস। আগের চেয়ে পরিবেশ ভালো। গুলিস্তানের মতো ঘিঞ্জি এলাকায় এমন ঘাস ও গাছ নেই যেখানে ছায়া পাওয়া যায়।

বন্ধুদের সাথে ঘুরতে আসা আলমগীর বলেন, আমরা পাঁচ বন্ধু এসেছি। গুলিস্তানেই দোকানে কাজ করি। আজ শুক্রবার ছুটি। তাই বন্ধুরা মিলে পার্কে বসে আড্ডা দিচ্ছি। এই পার্কে এখন বেশিকিছু নেই। শুধু বসে কিছুক্ষণ সময় কাটানো যায়।

সন্ধ্যায় হাঁটতে আসা চাকরিজীবী ইকবাল হাসান বলেন, দীর্ঘদিন নিরপত্তাহীন আর অবহেলিত থাকার পর শহীদ মতিউর রহমান পার্কটি প্রাণ ফিরে পেয়েছে। একসময় সন্ধ্যায় পার্কের ভেতরে বসত নেশাকারীদের আড্ডা। ছিল ছিনতাইয়ের ভয়। এছাড়া অসামাজিক কাজও হতো। তাই মানুষজন তেমন আসত না। এখন হাঁটার জন্য হলেও ১০ টাকা দিয়ে লোকজন এই পার্কে আসে। নিরাপত্তা নিশ্চিত, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা থাকলে নিয়মিত মানুষ এখানে আসবে।

পার্কটি মানুষের কাছে গুলিস্তান পার্ক হিসেবে পরিচিত। দীর্ঘদিন অযত্নে-অবহেলায় পড়ে থাকায় পার্কটি মাদকসেবী ও ছিনতাইকারীদের আড্ডা খানা আর ছিন্নমূল মানুষের বাসস্থানে পরিণত হয়েছিল। পার্কের আশপাশে ও ভেতরে ময়লার স্তুপ জমেছিল। নষ্ট হয়েছে গাছগাছালি। কিন্তু সংস্কারের পর নতুন রূপ পেয়েছে গুলিস্তানের শহীদ মতিউর পার্ক। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের ‘জল-সবুজে ঢাকা’ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে পার্কটির আধুনিকায়ন করা হয়েছে।

২০১৭ সালে ওই প্রকল্পের আওতায় ডিএসসিসি এলাকার ১৯টি পার্ক ও ১২টি খেলার মাঠ সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে অনেক পার্ক খুলে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। শহীদ মতিউর রহমান দর্শনার্থীদের জন্য ২০২২ সালের মার্চে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

শহীদ মতিউর রহমান পার্কের দায়িত্বে থাকা আবুল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে পার্কটি উন্মুক্ত ছিল। এখন প্রতি বছর ইজারা দেওয়া হয়। শুক্রবার-শনিবার দর্শনার্থী বেশি আসে। শুক্রবারে ১৫শর মতো টিকিট বিক্রি হয়। অন্যদিন ৭০০-৮০০ টিকিট বিক্রি হয়। সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত পার্ক খোলা থাকে।

শহীদ মতিউর রহমান পার্কের ইজারাদার অলিউল্যাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, পার্কটিতে এখন আমরা ভালো নিরপত্তা দিচ্ছি। দর্শনার্থীদের যেন কোনো সমস্যা না হয় এ বিষয়ে আমরা সজাগ থাকি। পার্কের সীমানা প্রাচীরের ওপর দিয়ে অনেক লোক বিনা টিকিটে ঢুকে পড়ে। সিটি করপোরেশনকে অনুরোধ করব সীমানা প্রাচীরের ওপর যেন কাচ বা কাঁটাতার দিয়ে দেয়। দর্শনার্থী বাড়লে রাইড আরও বাড়ানো হবে বলে জানান তিনি।

১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইউব খান বিরোধী আন্দোলনে নিহত শহীদ মতিউরের নামে গুলিস্তান পার্কের নামকরণ করা হয়েছিল।

আইবি/এসএসএইচ