১১শ আমানতকারীর লাভ-আসল কিছুই দিচ্ছে না আহমেদিয়া ফাইন্যান্স
২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে আহমেদিয়া ফাইন্যান্স অ্যান্ড কমার্স এমসিএস লিমিটেডে ৩৪ লাখ টাকা জমা রেখেছিলেন মিরপুরের ব্যবসায়ী আব্দুর রহিম। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির লভ্যাংশ দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। গত বছরের মার্চ থেকে এ পর্যন্ত লভ্যাংশও তো দূরের কথা, মূল টাকাও ফেরত দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। মূল টাকা ফেরত না পেয়ে দুশ্চিন্তায় আব্দুর রহিম স্ট্রোক করে মারা যান।
আব্দুর রহিমের স্ত্রী মর্জিনা বেগম (৫০) কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, স্বামী মারা গেল, ব্যবসাও বন্ধ। ৩৪ লাখ টাকা আটকা, লভ্যাংশও পাচ্ছি না। তিন সন্তান নিয়ে আমি বিপাকে আছি। ছয় মাস ধরে বাড়িভাড়াও দিতে পারছি না।
বিজ্ঞাপন
মর্জিনা বেগম বলেন, তাদের (আহমেদিয়া ফাইন্যান্স) পায়ে ধরেছি, মিনতি করেছি টাকাটা ফেরত দেওয়ার জন্য। কিন্তু তারা টাকা দেয়নি। অফিসে গেলে মারত, হুমকি দিত। প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ, আমাদের টাকাগুলো ফেরতের ব্যবস্থা করে দিন।
বিজ্ঞাপন
শুধু মর্জিনা বেগম নন, অধিক লাভের আশায় তার মতো প্রায় ১১শ আমানতকারী আহমেদিয়া ফাইন্যান্স অ্যান্ড কমার্স এমসিএস লিমিটেডে তিনশ কোটিরও বেশি টাকা রাখেন। কেউ ডিপিএস, কেউ এফডিআর করেছেন। কেউবা মাসিক ১২ থেকে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত লভ্যাংশের চুক্তিতে টাকা রেখেছেন। টাকা জমা রাখার প্রথম দিকে লভ্যাংশ পেলেও পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আসল টাকাও ফেরত দেওয়া হয় না।
রাজধানীর কাফরুলের ইব্রাহিমপুরের ৮২/৪ ভবনের চতুর্থ তলায় আহমেদিয়া ফাইন্যান্স অ্যান্ড কমার্স এমসিএস লিমিটেডের একটি কার্যালয় রয়েছে। আহমেদিয়া ফাইন্যান্সের করপোরেট অফিস বনানী পুরাতন ডিওএইচএসে। এখান থেকেই সব কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
প্রতিষ্ঠানটির বয়স দেড় দশকেরও বেশি। আমানতকারীদের অভিযোগ, তাদের টাকা আত্মসাতের মূলহোতা আহমেদিয়া ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনির আহমেদ ও মহাব্যবস্থাপক মো. সাইফুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন। তারা এখন পলাতক।
রাজধানীর ক্র্যাব কার্যালয়ে আজ (বুধবার) সংবাদ সম্মেলন করেন ভুক্তভোগী প্রতারিত আমানতকারীরা। পরে ক্র্যাব কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ ও মানববন্ধনও করেন তারা। সেখানে কথা হয় প্রতারণার শিকার এক আমানতকারীর সঙ্গে। তার নাম গিয়াস উদ্দিন।
তিনি বলেন, তিন বছরের চুক্তিতে মাসিক ২৩ হাজার টাকা লভ্যাংশ পাওয়ার আশায় ১০ লাখ টাকা দিই। প্রথমে কয়েক মাস লভ্যাংশ পেলেও ২০২১ সাল থেকে দিচ্ছে না। মূল টাকাও ফেরত দিচ্ছে না। আমার মতো শত শত ভুক্তভোগী রয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটির অফিসে ঘুরে লভ্যাংশ তো দূরের কথা মূল টাকাই ফেরত পাচ্ছি না। আ আমরা শত শত পরিবার অসহায় হয়ে পড়েছি। সারা জীবনের অল্প অল্প করে গচ্ছিত সঞ্চয় আজ হারাতে বসেছি।
প্রতারণার শিকার আমানতকারীদের মধ্যে রয়েছেন দিনমজুর, রিকশাওয়ালা, অবসরপ্রাপ্ত সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্য, পুলিশ সদস্য ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তাদের পেনশনের টাকা এখানে দীর্ঘমেয়াদি এফডিআর করেন।
জানা গেছে, মনির আহমেদ ও সাইফুল ইসলামসহ অন্য কর্মকর্তাদের ‘মিথ্যা’ প্রলোভনে বিশ্বাস করে প্রতিষ্ঠানে এফডিআরসহ মাসিক লভ্যাংশ পাওয়ার আশায় আমানতকারীরা টাকা জমা রাখেন। তাদের সেই জমার টাকা দিয়ে গড়ে ওঠে আহমেদিয়া অ্যাপার্টমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপার (প্রাইভেট) লিমিটেড, আহমেদিয়া টুইন টাওয়ার, ইউরোস্টার মডেল টাউন, ইউরোস্টার টাওয়ার, ইউরোস্টার অটো গ্যাস স্টোভ ফ্যাক্টরি, ইউরোস্টার পাম্প ফ্যাক্টরি, ইউরোস্টার হোম অ্যাপ্লায়েন্স ফ্যাক্টরির মতো প্রতিষ্ঠান।
আমানতকারীরা অভিযোগ করেন, অফিসে টাকার জন্য গেলে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ তার কর্মকর্তারা তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে এবং বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধামকি দেয়। এমনকি অনেক সময় মারধরসহ বিভিন্নভাবে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে।
গত ৫ সেপ্টেম্বর শত শত ভুক্তভোগী আমানতকারী আহমেদিয়া ফাইন্যান্সের এর অফিসে পাওনা টাকার জন্য অবস্থান ও অনশন শুরু করেন। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। আমানতকারীরা বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। কিন্তু অসাধু কিছু ব্যক্তি আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে সাধারণ মানুষের অর্থ আত্মসাৎ করছে।
টাকা ফেরতের দাবিতে বুধবারের বিক্ষোভে অংশ নেওয়া সিরাজুল ইসলাম নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, সাড়ে সাত লাখ টাকা দিয়েছি। পুরো পরিবার মিলে ৭০ লাখ টাকা দিয়েছি ২০১২ সালে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত লাখে ১৫শ টাকা দিত। ২০১৯ সালের পর লভ্যাংশ দেওয়া বন্ধ করে দেয়। মূল টাকাও ফেরত দিচ্ছে না।
তিনি বলেন, অফিসে গিয়ে মূল টাকা ফেরত চাইলে নানাভাবে ছল-চাতুরি করে কথা ঘুরাচ্ছে। কখনো হুমকি দিচ্ছে। মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে আত্মগোপনে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বাটপারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আজকে আমরা ১১শ’ গ্রাহক রাস্তায় দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছি।
সুলতানা রাজিয়া নামে প্রতারণার শিকার আরেক আমানতকারী বলেন, ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা আমানত হিসেবে রেখেছিলাম। চুক্তিতে ছিল আমি টাকা ফেরত চাইলে তারা এক সপ্তাহের মধ্যে টাকা ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে। আমার টাকার চুক্তির মেয়াদ শেষ। কিন্তু টাকা ফেরত দিচ্ছে না। টাকা ফেরত চাইলে তারা প্রতিশ্রুতি দেয়। আমরা গত মাসের ৫ তারিখ থেকে অফিসে অনশন করছি। অফিস ছেড়ে তারা বাইরে আত্মগোপনে গেছেন।
রাজিয়া বলেন, আমরা কই যাব? কার কাছে গেলে টাকা ফেরত পাব? পুলিশ আমাদের সহযোগিতা করছে না। আহমেদিয়া ফাইন্যান্স অ্যান্ড কমার্স এমসিএস লিমিটেডের কর্মকর্তারাও দেখা করছেন না, অফিসে আসেন না।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাফিজুর রহমান বলেন, আমরা শুরু থেকে মামলা করতে বলছি। কিন্তু আমানতকারীরা মামলা করতে রাজি নন। উল্টো তারা প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয় দখল করে আছেন এক মাস ধরে। কর্মকর্তারাও আসেন না। অফিসিয়াল কার্যক্রমও বন্ধ। টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না আমানতকারীরা। প্রতিষ্ঠানটির অধিকাংশ গ্রাহক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ব্যবসায়ী। এর কোনো সুরাহা হচ্ছে না। মামলা হলে পুলিশ আইনি পদক্ষেপ নিতে পারত।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনির আহমেদের মোবাইল নাম্বারে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মিটিং এ আছি, পরে কথা বলব।
জেইউ/আরএইচ