গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ, প্রতারণা ও দুর্নীতিতে অভিযুক্ত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের পৃষ্ঠপোষক এবং বরখাস্ত হওয়া বনানী থানার সাবেক পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) শেখ সোহেল রানাকে ফেরানো যায়নি এক বছরেও। অন্তত ১৪টি মামলার আসামি সোহেল রানা।

গত বছর গুলশান থানায় প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের একটি মামলা হয়। ওই মামলার আসামি করা হয় বনানী থানার তৎকালীন পরিদর্শক শেখ সোহেল রানাকে। আদালতের নির্দেশে তাকে গ্রেপ্তারে অনুমতি পায় গুলশান থানা। কিন্তু এর আগেই সোহেল রানা দেশ থেকে পালিয়ে যান এবং ভারতে গ্রেপ্তার হন।

এরপর থেকে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে কয়েক দফায় ভারতের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোকে (এনসিবি) চিঠি দেয় বাংলাদেশ পুলিশের সদরদপ্তর। কিন্তু ফেরানো সম্ভব হয়নি।

পুলিশ সদরদপ্তরের অপারেশন উইং সূত্রে জানা যায়, অনেকবারই চিঠি দেওয়া হয়েছে। গত বছরই পাঁচবার চিঠি দেওয়া হয় এনসিবিকে। কিন্তু কার্যকর কোনো রেসপন্স পাওয়া যায়নি।

গত বছরের ১৭ আগস্ট অগ্রিম অর্থ পরিশোধের পরও মাসের পর মাস পণ্য না পাওয়ায় ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে মামলা করেন প্রতারণার শিকার গ্রাহক মো. তাহেরুল ইসলাম। ওই সময় তার সঙ্গে প্রতারণার শিকার আরও ৩৭ জন উপস্থিত ছিলেন।

গ্রাহকের ১১শ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ওই মামলায় আসামি ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন, তার স্বামী মাসুকুর রহমান, আমানউল্ল্যাহ, বিথী আক্তার, কাউসার আহমেদ ও পুলিশের বনানী থানার পরিদর্শক শেখ সোহেল রানা।

শুরু থেকেই ই-অরেঞ্জের সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অস্বীকার করলেও অরেঞ্জ বাংলাদেশ নামে প্রতিষ্ঠান চালুর জন্য নেওয়া টিআইএন সনদে পরিচালক হিসেবে সোহেল রানার নাম দেখা যায়।

প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে সোহেল রানাসহ কয়েকজনকে আসামি করে গত ১৩ সেপ্টেম্বর গুলশান থানায় আরও একটি মামলা করেন এক গ্রাহক। প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে রাজধানীর শুধু গুলশান থানাতেই এ নিয়ে ১৪টি মামলা হয়। যার কয়েকটি মামলা সিআইডি ও দুদক তদন্ত করছে। এর বাইরে কোতোয়ালি থানায় চারটি মামলা হয়। এরমধ্যে ১৪টি মামলার আসামি সোহেল রানা।

গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের মধ্যেই গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারের চ্যাংড়াবান্দায় ওই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে ধরা পড়েন সোহেল রানা। বিএসএফের জিজ্ঞাসাবাদে সোহেল রানা জানিয়েছেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তারা শেখ সোহেল রানাকে চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্ত থেকে গ্রেপ্তার করে। বিএসএফের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহল দিয়ে তিনি দালালের মাধ্যমে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করেন। বাংলাদেশে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর পুলিশ বিভাগ থেকে সাত দিনের ছুটি নিয়ে তিনি সীমান্তের দিকে রওনা হন। তার গন্তব্য ছিল নেপালের কাঠমান্ডু। সেখানে তার এক বোন থাকেন। শিলিগুড়িতে এসে বোনের স্বামীর তাকে নেপালে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল।

সোহেল রানার কাছ থেকে বাংলাদেশ ছাড়াও থাইল্যান্ড ও ব্রিটেনের একটি ব্যাংকের কার্ড পাওয়া যায়। তার পাসপোর্টে থাইল্যান্ড, সৌদি আরব, ফ্রান্স, চীনসহ বিভিন্ন দেশের ভিসা রয়েছে বলে জানায় বিএসএফ।

ভারতে সোহেল রানা গ্রেপ্তার হওয়ার পর নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশ পুলিশ। তার প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ ও দুর্নীতির অভিযোগের বিরুদ্ধে তদন্তে প্রাথমিক সত্যতা মেলে। ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে আটকের পর পুলিশ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় সোহেল রানাকে। তদন্ত কমিটি হয়। থানায় মামলা নথিভুক্ত হয়।

গ্রাহকের সাড়ে ২৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের পৃষ্ঠপোষক এবং বরখাস্ত হওয়া বনানী থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) সোহেল রানার বিরুদ্ধে গত বছরের ১৪ জুলাই মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ সংস্থাটির উপ-পরিচালক মো. মোনায়েম হোসেন বাদী হয়ে মামলাটি করেন। এর আগে ৪ জুলাই কমিশন থেকে মামলাটি অনুমোদন দেওয়া হয়।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, সোহেল রানার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম এবং দুর্নীতির মধ্যে ই-কমার্স গ্রাহকদের টাকা আত্মসাৎ, বিদেশে পাচার ও দেশত্যাগের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা এ বিষয়ে প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেন।

ওই প্রতিবেদনে  বলা হয়, শেখ সোহেল রানা নিজের পদ-পদবি আড়াল করে দুর্নীতি সম্পৃক্ত অপরাধে ই-অরেঞ্জ নামে ই-কমার্স কোম্পানি খোলেন। এরপর প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ গ্রাহকদের কাছ থেকে বেশি লাভের প্রলোভন দেখিয়ে ছয়টি ব্যাংকে নিজ নামে এবং তার সংশ্লিষ্টদের নামে পরিচালিত ৩১টি হিসাবে মোট ২৮ কোটি ৪৯ লাখ ৩৭ হাজার ৬৫০ টাকা জমা করেন। এর মধ্যে ২৮ কোটি ৪৬ লাখ ৭২ হাজার ৯১৩ টাকা উত্তোলন করেছেন তিনি।

অন্যদিকে গত বছরের ৩ অক্টোবর গুলশান থানায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা দায়ের করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সেই মামলায় চার নম্বর আসামি ছিলেন সোহেল রানা।

মানি লন্ডারিং মামলায় ফাঁসছেন সোহেল রানা

সিআইডির তদন্তাধীন মামলায় অভিযুক্ত শেখ সোহেল রানার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগতভাবে ই-অরেঞ্জ শপের সিটি ব্যাংকের গুলশান এভিনিউ শাখা থেকে ১৭ বারে নগদ মোট দুই কোটি ৪৭ লাখ ৭৮ হাজার ৫০০ টাকা উত্তোলনের প্রমাণ মিলেছে। অর্থাৎ অবৈধভাবে তিনি সেই টাকা নিজের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তরের পর উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন বলে সিআইডি সূত্রে জানা গেছে।

যোগাযোগ করা হলে মানি লন্ডারিং মামলার তদন্ত তত্ত্বাবধায়ক সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের (ফিনান্সিয়াল ক্রাইম) বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, ই-অরেঞ্জের সঙ্গে জড়িত অন্যরাসহ বরখাস্ত হওয়া পুলিশ পরিদর্শক সোহেল রানার বিরুদ্ধে দায়ের করা মানি লন্ডারিং মামলার তদন্ত শেষ মুহূর্তে। সোহেল রানার বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। তাকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন। আমরা পুলিশ সদর দপ্তরকে চিঠি দিয়েছি। যথাযথ প্রক্রিয়ায় তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে তার বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হবে।

কেন ফেরানো যাচ্ছে না সোহেল রানাকে?

সোহেল রানাকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ভারতের দিল্লির ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোকে (এনসিবি) কয়েক দফায় চিঠিও দিয়েছে পুলিশ সদরদপ্তর। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সাড়া মেলেনি।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পুলিশ সদরদপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মো. ইহসান সাত্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভারতে গ্রেপ্তার সোহেল রানাকে ফেরত চেয়ে গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর দিল্লির এনসিবিকে প্রথম চিঠি পাঠানো হয়।  ১৮ সেপ্টেম্বর তৃতীয় দফায় চিঠি দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, সোহেল রানার বিরুদ্ধে সেখানে (ভারতে) মামলা হয়েছে। তিনি রিমান্ডেও ছিলেন। সেদেশের আইনি বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে কার্যকরী ‍উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বলতে পারেন, এক রকম সেদেশের আইনি প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে আপাতত ফেরানো সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমরা আশাবাদী, হয়তো চলতি বছরের শেষ নাগাদ সোহেল রানাকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।

জেইউ/আরএইচ