বঙ্গবন্ধুর ডাকে সর্বাত্মক হরতাল, রেডিও পাকিস্তানের নাম পরিবর্তন
৪ মার্চ, ১৯৭১। এদিন ছিল দেশব্যাপী লাগাতার হরতালের তৃতীয় দিন। গণবিক্ষোভে টালমাটাল দিনটিতে ঢাকাসহ সারাদেশ অচল হয়ে পড়ে।
সামরিক জান্তার সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে আসে হাজার হাজার মানুষ। ‘রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা’র নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘ঢাকা বেতারকেন্দ্র’। আর সেই ঘটনা চলমান আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। যা আমাদের মুক্তির পথকে এগিয়ে নেয়।
বিজ্ঞাপন
এদিন পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের নেত্রী কবি সুফিয়া কামাল ও মালেকা বেগম যৌথ বিবৃতিতে ৬ মার্চ বায়তুল মোকাররম এলাকায় প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানান। ৪ মার্চের এদিনে খুলনায় বাঙালি-অবাঙালিদের মাঝে হয় এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। হরতাল চলাকালে খুলনায় সেনাবাহিনীর গুলিতে ৬ জন শহীদ হন।
বঙ্গবন্ধুর আহ্বানের পর স্বাধিকার আন্দোলনে গুলিতে আহত মুমূর্ষু বীর সংগ্রামীদের প্রাণরক্ষার্থে শত শত নারী-পুরুষ ও ছাত্রছাত্রী ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ব্লাড ব্যাংকে স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন। রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ এবং পাকিস্তান টেলিভিশন ‘ঢাকা টেলিভিশন’ হিসেবে সম্প্রচার শুরু করে।
বিজ্ঞাপন
বেতার-টেলিভিশন শিল্পীরা ঘোষণা করেন, যতদিন পর্যন্ত দেশের জনগণ ও ছাত্রসমাজ সংগ্রামে লিপ্ত থাকবেন ততদিন ‘বেতার ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তারা অংশ নেবেন না’।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, চরম ত্যাগ স্বীকার ছাড়া কোনোদিন কোনো জাতির মুক্তি আসেনি। তিনি উপনিবেশবাদী শোষণ ও শাসন অব্যাহত রাখার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বানে সাড়া দেয়ায় বীর জাতিকে অভিনন্দন জানান।
বঙ্গবন্ধু ৫ ও ৬ মার্চ সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, যেসব সরকারি ও বেসরকারি অফিসে কর্মচারীরা এখনও বেতন পাননি শুধু বেতন প্রদানের জন্য সেসব অফিস দুপুর আড়াইটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
করাচি প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান দেশকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান।
পিডিপিপ্রধান নূরুল আমিন এক বিবৃতিতে ১০ মার্চ রাজনৈতিক নেতাদের সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে প্রেসিডেন্টের প্রতি অবিলম্বে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় আহ্বান করার দাবি জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৫ জন শিক্ষক পৃথক বিবৃতিতে ঢাকার ‘পাকিস্তান অবজারভার’ পত্রিকার গণবিরোধী ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জেডএ ভুট্টো করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দেশের সংহতির জন্য তার দল যতদূর সম্ভব ৬-দফার কাছাকাছি হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
পূর্ব পাকিস্তানের বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি অবসানের জন্য তিনি এখন জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে রাজি হবেন কি না- এ প্রশ্নের জবাবে ভুট্টো বলেন, ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত ঘটছে। এ সম্পর্কে অবহিত করার জন্য আমরা সাংবাদিকদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করব।
পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা কার্ফু দিয়েও বীর বাঙালিদের ঘরে আটকে রাখতে পারছিল না। তাই গোপনে আঁটতে থাকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে বাঙালি নিধনের পরিকল্পনা। এদিকে আন্দোলনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা দফায় দফায় বৈঠকে বসেন ৭ মার্চের জনসভা সফল করার জন্য। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) চলতে থাকে জনসভার প্রস্তুতি।
পাশাপাশি ঢাকাসহ সারাদেশেই গঠন হতে থাকে সংগ্রাম কমিটি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের যুব ও ছাত্রনেতারা গোপনে নানা স্থান থেকে অস্ত্র সংগ্রহ অভিযান চালাতে থাকেন বেশ জোরেশোরেই।
একাত্তরের এই দিনে ক্ষুব্ধ বাঙালির মিছিলে মিছিলে ঝাঁঝালো স্লোগানে উচ্চকিত ছিল সারাদেশ। প্রধান স্লোগান ছিল- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্ম-মেঘনা-যমুনা’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’।
এদিকে ৭ মার্চ যতই এগিয়ে আসতে শুরু করে, স্বাধীনতাকামী বাঙালি ও পাক সামরিক জান্তার মধ্যে উত্তেজনা ততই বাড়তে থাকে। দ্রোহ-ক্ষোভে বঞ্চিত-শোষিত বাঙালি তখন ক্রমেই ফুঁসে উঠেছিল ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে। তারা একবুক প্রত্যাশা নিয়ে বসে থাকে ৭ মার্চ কী ঘোষণা দেবেন বঙ্গবন্ধু।
অন্যদিকে পাক সামরিক জান্তা ভয়ে কাতর, যদি বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তখন কী হবে? এমন আতঙ্ক, ভয় তাদের তাড়িত করে।
সূত্র: স্বাধীনতার দলিল, দ্বিতীয় খণ্ড, বাংলা একাডেমি ও অন্যান্য
এইচকে