কারসাজির সুযোগ নিচ্ছে মিল মালিক থেকে খুচরা ব্যবসায়ী সবাই

গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে চিনির উৎপাদন কমে গেছে। তাই চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অতি মুনাফার লোভে কেউ মজুত করেছে, অনেকে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে, আবার কেউ কেউ মজুত থাকা সত্ত্বেও বিক্রি করছে না। এভাবে কারসাজি করে চিনির বাজারকে অস্থিতিশীল করে তোলা হয়। দাম বাড়ানোর এ সুযোগ নেয় মিল মালিক, রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানসহ ডিলার, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা।

চিনির মূল্য ও সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের করা বিশেষ তদন্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে বাজার স্থিতিশীল করতে চিনি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিনির সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে কঠোর নির্দেশনার পাশাপাশি উৎপাদনকারী মিলগুলোতে পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে সুপারিশ করেছে অধিদপ্তর।

প্রতিবেদনে বলা হয়, চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর বাজার নিয়ন্ত্রণে ঢাকা মহানগরসহ দেশব্যাপী বাজার তদারকি/অভিযান পরিচালিত হয়। এসব অভিযানে চিনির উৎপাদন পর্যায়ে এবং পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিক্রি কার্যক্রম তদারকি করা হয়।

চিনি উৎপাদনকারী পাঁচ শীর্ষ প্রতিষ্ঠানে অভিযান

চিনির বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠায় বিশেষ অভিযানে নামে ভোক্তা অধিদপ্তর। এসময় দেশের চিনি উৎপাদনকারী পাঁচ শীর্ষ প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করা হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো— মেঘনা সুগার রিফাইনারি লিমিটেড, সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ, আবুল মোনেম সুগার রিফাইনারি, দেশবন্ধু সুগার মিল এবং এস আলম সুগার রিফাইনারি লিমিটেড। তদারকিকালে বেশকিছু অসঙ্গতি পায় অধিদপ্তর।

আরও পড়ুন : দিনে চিনির ঘাটতি দেড় হাজার টন

মেঘনা সুগার রিফাইনারিতে দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা তিন হাজার টন থাকলেও গত ২০ অক্টোবর থেকে ১৯৭৪ টন চিনি উৎপাদন করছে। সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ (তীর ব্র্যান্ড) সক্ষমতার চেয়ে প্রায় ৫০ ভাগ কম চিনি উৎপাদন করছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন কমে গেছে। আবুল মোনেম সুগার রিফাইনারিও একই কারণে উৎপাদন কমিয়েছে।

নরসিংদীর পলাশ এলাকার দেশবন্ধু সুগার মিল গ্যাস ও বিদ্যুতের কোনো সংকট নেই বলে সক্ষমতা অনুযায়ী চিনি উৎপাদন করছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি চাহিদা অনুযায়ী চিনি সরবরাহ করছে না। একাধিক সাপ্লাই অর্ডারের মেয়াদ শেষ হওয়ার ১০ থেকে ১২ দিন পর চিনি সরবরাহ করছে। তাদের মূল্য তালিকা নেই। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এলাকার এস আলম সুগার রিফাইনারিতে উৎপাদন কার্যক্রম চলমান আছে। ৫০ কেজির বস্তায় ২০০ থেকে ২৮০ গ্রাম কম চিনি দেওয়া হচ্ছে। কারখানার বস্তায় বিক্রয়মূল্য থাকলেও বাজারে বস্তায় কোনো মূল্য নেই।

২৭৮ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা

চিনি নিয়ে কারসাজি ও কৃত্রিম সংকটকারীদের ধরতে দেশব্যাপী বিশেষ অভিযানে নামে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ১০৩টি তদারকি ও অভিযান পরিচালনা করা হয়। এসময় বেশি দামে চিনি বিক্রি ও মজুতের অপরাধে ২৭৮ প্রতিষ্ঠানকে ১৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

ডিলার, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে অভিযান

ঢাকার মৌলভীবাজার, কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, টাউনহল মার্কেট, মিরপুর শাহআলী মার্কেট, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জসহ দেশের প্রায় সব জেলার বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা বাজারে তদারকি করা হয়।

অভিযানে দেখা যায়, বাজারগুলোতে সরকার নির্ধারিত মূল্যে খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে না এবং বাজারে চিনির সরবরাহ কম। বাজারে প্যাকেটজাত চিনির সরবরাহ কম। কোথাও প্যাকেটজাত চিনির প্যাকেট কেটে খোলা চিনি হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে। কিংবা প্যাকেটের এমআরপি মুছে বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে।

তদারকিকালে পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, মিলগেট, খাতুনগঞ্জ বা মৌলভীবাজার থেকে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে চিনি কিনতে হচ্ছে। অপরদিকে খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে চিনি কিনতে হচ্ছে।

আরও পড়ুন : ‘রিফাইন করা চিনি বাজারে এলে আর সমস্যা থাকবে না’

অভিযানে বেশিরভাগ পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীর কাছে কেনার ভাউচার পাওয়া যায়নি। এর কারণ হিসেবে তারা জানান, মিলগেট বা মৌলভীবাজার, খাতুনগঞ্জের মতো বড় পাইকারি বাজার থেকে তাদের ক্রয় ভাউচার দেওয়া হয় না। দুএকজন ব্যবসায়ী ভাউচার দিলেও সেখানে চিনির পরিমাণ উল্লেখ ছিল কিন্তু টাকার পরিমাণ নেই।

পাইকারি ব্যবসায়ীরা আরও জানান, ডিলারদের কাছ থেকে চাহিদা মোতাবেক চিনি পাচ্ছেন না। দুই মাস আগে অর্ডার করা চিনি এখনো সরবরাহ করা হয়নি।

সোমবার (২৪ অক্টোবর) চিনির মিল মালিক, পরিবেশক, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা, ক্যাব, বাজার ব্যবসায়ী সমিতি, ট্যারিফ কমিশনের প্রতিনিধি ও পেট্রোবাংলার প্রতিনিধির সঙ্গে মতবিনিময় করে অধিদপ্তর। সভায় জানানো হয়, এখন পর্যন্ত পাইপ লাইনে মোট ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৬৭৫ টন চিনি মজুত আছে এবং ঘাটতি নেই।

যে কারণে চিনির বাজার অস্থিতিশীল

মিলে চিনির উৎপাদন ও সরবরাহ কম : চিনি উৎপাদনের ক্ষেত্রে নির্ধারিত চাপের গ্যাস প্রয়োজন হয়। কিন্তু চিনি উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে পরিমাণে গ্যাসের চাপ প্রয়োজন বর্তমানে সে পরিমাণে গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে না মিলগুলোতে। ফলে চিনির উৎপাদন কম হওয়ায় বাজারে চিনির সরবরাহ কম হচ্ছে।

মুদ্রিত (পাকা) ভাউচার প্রদান না করা : চিনি ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে মুদ্রিত (পাকা) ভাউচার প্রদান করা হচ্ছে না। ফলে প্রতিটি স্তরে মূল্য কারসাজির সুযোগ নেওয়া হচ্ছে।

এলসি খোলার জটিলতা : বড় এলসি খোলার ক্ষেত্রে অসুবিধা হচ্ছে বলে জানায় রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানগুলো। তারা জানায়, আগের মতো সহজে এলসি খুলতে পারছে না।

মিলগেটে ট্রাকে চিনি লোডের ক্ষেত্রে দীর্ঘসময় জটিলতা : চিনি সরবরাহ নিতে ট্রাকগুলোকে ৭-৮ দিন পর্যন্ত মিলগেটে অপেক্ষা করতে হয়। তাদের দীর্ঘসময় অপেক্ষার ফলে চিনি পরিবহনের খরচ বেড়ে যায়।

ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব : ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবেও চিনির বাজার অস্থিতিশীল হয়েছে বলে ব্যবসায়ীরা জানান।

শুল্কহারের সমন্বয় : চিনি আমদানির ক্ষেত্রে এখনও শুল্কহার অত্যধিক বলে রিফাইনারির মালিকরা উল্লেখ করেন। তারা শুল্কহার সমন্বয়ের প্রস্তাব করেন।

সুপারিশ :

বর্তমান চিনির বাজার স্থিতিশীলতার বেশকিছু সুপারিশ করেছে ভোক্তা অধিদপ্তর। সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে—

•মিলগুলোকে তাদের সর্বোচ্চ উৎপাদন এবং সরবরাহ অব্যাহত রাখার নির্দেশনা প্রদান।

•মিল থেকে খুচরা পর্যায়ে পর্যন্ত চিনি কোথাও অসাধু উদ্দেশে মজুত করে বাজার অস্থিতিশীল করছে কি না গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক তা নজরদারি করা।

• চিনির বাজার স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত মোবাইল কোর্ট/বাজার অভিযান অব্যাহত থাকতে হবে।

•মূল্য পর্যালোচনার জন্য ‘মূল্য নির্ধারণ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির’ নিয়মিত সভা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

•চিনি উৎপাদনকারী মিলগুলোতে নির্ধারিত চাপের গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

•মিল মালিক থেকে খুচরা পর্যায়ে ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে মুদ্রিত (পাকা) ভাউচার প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

•এলসি খোলার ক্ষেত্রে বিদ্যমান জটিলতা দূর করতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃক ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা প্রদানের নির্দেশনা।

•মিলগেটে চিনি পরিবহনে (ট্রাক) সরবরাহ করতে অপেক্ষমাণ সময় কমিয়ে আনতে হবে।

এলাকা ভিত্তিক ডিলার নির্ধারণ করে সেই ডিলারদের মাধ্যমে এলাকার বাজারগুলোতে চিনি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

এসআই/এসএসএইচ