করোনার বছর আলোচিত চরিত্র সাহেদ করিম

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর থমকে যায় গোটা বিশ্ব। স্থবির হয়ে পড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য। লাখো মানুষকে হারিয়ে শোকে কাতর বিশ্ব যখন ঘুরে দাঁড়াতে ব্যস্ত, ঠিক তখন উল্টো ঘটনা ঘটে বাংলাদেশে। যে বিভাগের কাঁধে ভর করে সংকটময় এ মুহূর্ত উতরে যাওয়ার কথা, সেই স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বারবার জড়িয়েছে বিতর্কে।

অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে দুদক পরিচালকসহ তিনজনকে। আক্রান্ত হয়েছেন একাধিক মহাপরিচালক ও পরিচালকসহ ৮০ জনেরও বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী

দেশে করোনার রোগী শনাক্তের এক বছরের মধ্যে ঘটে গেছে মাস্ক কেলেঙ্কারি, করোনা টেস্ট জালিয়াতি, ত্রাণসামগ্রী আত্মসাতের মতো ঘটনা। কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই নকল মাস্ক ও পিপিই সরবরাহ, ভুয়া করোনা রিপোর্ট দিয়ে স্বাস্থ্য খাতে শত কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা ঘটে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে করোনার ভয় উপেক্ষা করে অভিযান চালাতে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক)। অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে দুদক পরিচালকসহ তিনজনকে। আক্রান্ত হয়েছেন একাধিক মহাপরিচালক ও পরিচালকসহ ৮০ জনেরও বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৪৪১টি অভিযোগ অনুসন্ধান, ২৯৮টি মামলা এবং ১৬৬টি মামলার চার্জশিট দিতে সক্ষম হয়েছে সংস্থাটি।

করোনার বছর আলোচিত সাহেদ করিমের চরিত্রটি ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে

এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার সংকটকালেও দেশে দুষ্টচক্রের কালো হাত থেমে ছিল না। সে কারণে মাস্ক কেলেঙ্কারি, করোনা টেস্ট জালিয়াতি, ত্রাণসামগ্রী আত্মসাতের মতো ঘটনা আমাদের সামনে এসেছে। আমরাও দায়িত্ব পালনে পিছপা হইনি। তাদের বিরুদ্ধে আইনি উদ্যোগ গ্রহণ করি।

দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বেশকিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তিনজন প্রতিশ্রুতিশীল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে হারিয়েছি। তারপরও দুর্নীতিপরায়ণদের সুখকর সময় পার করতে দেওয়া হয়নি

ইকবাল মাহমুদ, চেয়ারম্যান, দুদক

তিনি বলেন, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বেশকিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তিনজন প্রতিশ্রুতিশীল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে হারিয়েছি। তারপরও দুর্নীতিপরায়ণদের সুখকর সময় পার করতে দেওয়া হয়নি।

নিম্নমানের স্বাস্থ্যসুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ

করোনা মহামারির মধ্যে নিম্নমানের মাস্ক, পিপিই ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসুরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয় ও সরবরাহের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ছিল গত বছরের আলোচিত ইস্যু। দুদকের অনুসন্ধানেও ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) ছয় কর্মকর্তা এবং মেসার্স জেএমআই হসপিটাল রিক্যুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুদক। মামলার এজাহারে জেএমআই গ্রুপের ২০ হাজার ৬১০টি সরবরাহ করা মাস্ক ‘এন-৯৫’ মাস্ক নয় বলে উল্লেখ করা হয়। মামলাটির তদন্ত এখনও চলমান।

ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে চার কোটি টাকা হাতিয়ে নেন আরিফুল হক চৌধুরী ও তার স্ত্রী ডা. সাবরিনা

সাহেদ করিম ও রিজেন্ট হাসপাতাল

লাইসেন্স নবায়নবিহীন রিজেন্ট হাসপাতালকে ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতালে রূপান্তর, সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে কোভিড পরীক্ষা করেও অবৈধভাবে গ্রাহকের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে গত বছর। এ ঘটনায় আলোচিত রিজেন্ট গ্রুপ ও রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমের চরিত্রটি ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এ ঘটনায় মামলা করে দুদক। মামলায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক আমিনুল হাসান ও সাহেদ করিমসহ পাঁচজনকে আসামি করা হলেও বাদ যায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদের নাম। মামলায় তিন কোটি ৩৪ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনে দুদক। এছাড়া সাহেদের বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, আয়কর ফাঁকি, ভুয়া নাম ও পরিচয়ে ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎসহ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ তদন্ত করছে দুদক।

বিনামূল্যে কোভিড পরীক্ষা করেও অবৈধভাবে গ্রাহকের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে গত বছর। এ ঘটনায় আলোচিত রিজেন্ট গ্রুপ ও রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমের চরিত্রটি ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে

ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে জেকেজির অর্থ আদায়

২০২০ সালের মার্চে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে সরকারের কাছ থেকে বিনামূল্যে কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহের অনুমতি নেয় জেকেজি হেলথ কেয়ার। যদিও নমুনা সংগ্রহের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি নমুনা সংগ্রহের পর তা পরীক্ষা না করেই ভুয়া সনদ সরবরাহ করে তারা। এ ঘটনায় ২২ জুন জেকেজির সাবেক দুই কর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী আরিফুল হক চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে চার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ায় অভিযোগে আরিফুল হক চৌধুরীর স্ত্রী ডা. সাবরিনা আরিফের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে দুদক। প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার পর তাকেও গ্রেফতার করা হয়। মামলাটি এখনও চলমান।

জেকেজির সাবেক দুই কর্মীকে গ্রেফতারের পর তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী আরিফুল হক চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে চার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে তার স্ত্রী ডা. সাবরিনা আরিফের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে দুদক। প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার পর তাকেও গ্রেফতার করা হয়

হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে দুর্নীতি

হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগে চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, কুমিল্লা, সাতক্ষীরা ও পাবনাসহ বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের ঠিকাদার ও ক্রয় কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রায় ২৪টি মামলা দায়ের করে দুদক। এছাড়া স্বাস্থ্য খাতে ৭০ জনের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের অনুসন্ধান করে সংস্থাটি।

করোনার বছর আলোচনায় ছিলেন কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল ও তার পরিবারের সদস্যরা

এমপি পাপুল দম্পতির কাণ্ড

মানবপাচার, অর্থপাচার ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের শোষণের অভিযোগে গত ৬ জুন কুয়েতের মুশরিফ এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় লক্ষ্মীপুর- ২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলকে। শ্রমিক হিসেবে কুয়েতে গিয়ে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলা পাপুল ২০১৮ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পাপুল নিজে এমপি হওয়ার পর স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের কোটায় পাওয়া সংরক্ষিত একটি আসনে তার স্ত্রী সেলিনাকেও এমপি করেন। পাপুল কুয়েতে গ্রেফতার হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে অর্থপাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে নামে দুদক। গত ১১ নভেম্বর পাপুল, তার স্ত্রী, শ্যালিকা জেসমিন প্রধান এবং মেয়ে ওয়াফা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। যেখানে দুই কোটি ৩১ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ এবং ১৪৮ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ আনা হয়। এরই মধ্যে তাদের নামে ৬১৩টি ব্যাংক হিসাব  ফ্রিজ করা হয়েছে। অন্যদিকে, কুয়েতে ফৌজদারি আদালত থেকে গত ২৮ জানুয়ারি ঘোষিত রায়ে নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন পাপুল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২২ ফেব্রুয়ারি তার আসনটি শূন্য ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করা হয়।

পাপুল কুয়েতে গ্রেফতার হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে অর্থপাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে নামে দুদক। গত ১১ নভেম্বর পাপুল, তার স্ত্রী, শ্যালিকা জেসমিন প্রধান এবং মেয়ে ওয়াফা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। যেখানে দুই কোটি ৩১ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ এবং ১৪৮ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ আনা হয়

স্বাস্থ্যের গাড়িচালকের শত কোটি টাকার সম্পদ

স্বাস্থ্য অধিদফতরের আলোচিত গাড়িচালক আবদুল মালেকের নামে চারটি বাড়ি ও তিনটি প্লটসহ শত কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পায় র‌্যাব ও দুদক। এরই মধ্যে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি দুদকের মামলায় মালেক ও তার স্ত্রী নার্গিস বেগমের বিরুদ্ধে সোয়া তিন কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ আনা হয়। 

গত ২০ সেপ্টেম্বর তুরাগের বামনারটেক এলাকার একটি সাততলা ভবন থেকে গ্রেফতার হন আবদুল মালেক। র‌্যাবের দাবি, এ সময় তার কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগজিন, পাঁচ রাউন্ড গুলি, দেড় লাখ জাল বাংলাদেশি টাকা, একটি ল্যাপটপ ও একটি মোবাইল জব্দ করা হয়। অষ্টম শ্রেণি পাস মালেক ১৯৮২ সালে প্রথম সাভার স্বাস্থ্য প্রকল্পের গাড়িচালক হিসেবে যোগ দেন। 

৯৪ জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে ত্রাণ আত্মসাতের অভিযোগ

করোনাকালে হতদরিদ্র মানুষের নামে বরাদ্দ দেওয়া ত্রাণসামগ্রী আত্মসাতের অভিযোগে বিভিন্ন জেলার ৯৪ জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। এর মধ্যে ৩০ জন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং ৬৪ জন ইউপি সদস্য রয়েছেন। সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচিতে বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে এখন পর্যন্ত ২১টি মামলা করেছে দুদক। এসব মামলায় অনেককেই গ্রেফতার করা হয়।

আরএম/এমএআর/এমএমজে