• ছেলে-মেয়ে, শ্যালক, ভাতিজাসহ ৪২৬ জনকে নিয়োগ
• গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মাঠে নেমেছে দুদক
• ইউজিসি’র তদন্তে নিয়োগ-দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির প্রমাণ
• নিয়োগ বাতিলের সুপারিশের পরও বহাল বিতর্কিতরা 
 
শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে সীমাহীন দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির দৃষ্টান্ত গড়েছেন খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুকৃবি) প্রথম উপাচার্য মো. শহীদুর রহমান খান। অভিযোগের পাহাড় নিয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরে যেতে হয়েছে।

তবে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে গেলেও তার শেষরক্ষা হচ্ছে না। দুর্নীতির আমলনামা নিয়ে শেষ পর্যন্ত দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মুখোমুখি হতে হচ্ছে শহীদুর রহমানকে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কমিশন থেকে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

সংস্থাটির দৈনিক ও সাম্প্রতিক অভিযোগ সেলের সুপারিশের পর কমিশন থেকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর তদন্ত বিভাগের মহাপরিচালককে এ ব্যাপারে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্তে মো. শহীদুর রহমান খানের বিরুদ্ধে নিয়োগ দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। যার ভিত্তিতে উপাচার্যের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া নয় স্বজন এবং ৭৩ শিক্ষকের নিয়োগ বাতিল করতে বলেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যদিও সেই সিদ্ধান্ত এখনও বাস্তবায়ন করা হয়নি। উল্টো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে চিঠি দিয়েছে। নিয়োগ বাতিল না করে কেন বিতর্কিতদের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হলো— এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে।

তার লাগামহীন নিয়োগ বাণিজ্যের কারণে শিক্ষাঙ্গনটিতে শিক্ষার্থীর চেয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৫০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী আছেন ৪৪৭ জন

এ বিষয়ে জানতে চাইলে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুকৃবি) রেজিস্ট্রার খান মাজহারুল আনোয়ার (শাহজাহান) ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইউজিসি’র সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় ওই নিয়োগ বাতিলের সিদ্ধান্ত দেয়। আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য মন্ত্রণালয়কে লিখেছিলাম। বিষয়টি এখন ওই অবস্থাতেই আছে। এরপর মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে আর কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়নি। বাকি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করবে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য প্রফেসর ড. দিল আফরোজা বেগম এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইউজিসি থেকে তদন্তের পর আমাদের সুপারিশ ছিল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ভিসিকে নিয়োগ বাতিলের জন্য বলা হয়। তখন তো ভিসি ছিল না। নতুন ভিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখন তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানি। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে নতুন কিছু আমাদের জানানো হয়নি।

শহীদুর রহমানের যত কুকীর্তি

ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শহীদুর রহমান খান ছিলেন খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে ক্যাম্পাসে প্রথম পা রাখেন শহীদুর রহমান খান। তার লাগামহীন নিয়োগ বাণিজ্যের কারণে শিক্ষাঙ্গনটিতে শিক্ষার্থীর চেয়ে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৫০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী আছেন ৪৪৭ জন।

শুধু মেয়েকে নয়, উপাচার্য নিজের স্ত্রীকেও সরাসরি অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রে কোনো শর্ত পূরণ করা হয়নি, বলছে তদন্ত কমিটি। এছাড়া মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ পাওয়া মো. আশিকুল আলমের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে

ওই ৪৪৭ জনের মধ্যে উপাচার্য নিজের ছেলে-মেয়ে, শ্যালক, ভাতিজাসহ ৪২৬ জনকে নিয়োগ দেন। তবে, স্ত্রীকে নিয়োগ দিতে গেলে বাধ সাধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপরই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের বিষয়গুলো সামনে আসে। যার পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের ৩ আগস্ট উপাচার্যের ছেলে-মেয়েসহ নয় স্বজন এবং ৭৩ শিক্ষকের নিয়োগ বাতিলের নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। আগেও তার বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ রাখতে চিঠি দিয়েছিল ইউজিসি। তারপরও ৪০ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেন উপাচার্য। শুধু তা-ই নয়, মেয়াদ শেষ হওয়ার শেষ দিকে এসে এ বছরের জুলাইয়ে পরিচালকসহ আরও ২৩ জনকে নিয়োগ দিতে বিজ্ঞপ্তি দেন তিনি। তবে, বিভিন্ন আপত্তির মুখে এ কার্যক্রম শেষ করে যেতে পারেননি। অনিয়ম ও দুর্নীতির বোঝা মাথায় নিয়ে চলতি বছরের ১০ সেপ্টেম্বর রাতের আঁধারে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছাড়েন শহীদুর রহমান খান।

বিশ্ববিদ্যালয়টির একাডেমিক পথচলা শুরু হয় ২০১৯ সালের ৪ এপ্রিল। চার বছরে পাঁচ অনুষদের ৪৩টি বিভাগ চালু করেন উপাচার্য শহীদুর। দায়িত্ব নিয়েই অস্থায়ী ভিত্তিতে জনবল নিয়োগ শুরু করেনতিনি। পরে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সেই পদগুলো স্থায়ী করেন। ২০১৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর প্রথম ধাপে ২৯ শিক্ষকসহ ৭৬ জনকে চূড়ান্ত নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন উপাচার্য। তিনি নিজেই ছিলেন নিয়োগ বোর্ডের প্রধান। নিয়োগে অনিয়ম দেখে ২০২০ সালের ২৪ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে উপাচার্যের বিরুদ্ধে নালিশ জানান সিন্ডিকেটের পাঁচ সদস্য।

ইউজিসি’র তদন্তে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ার পর উপাচার্যের ওই নয় আত্মীয়-স্বজনের নিয়োগ বাতিল করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে বিশেষজ্ঞ ছাড়া একই ব্যক্তিদের দিয়ে বাছাই বোর্ড গঠন করে ২০টি বিষয়ে নিয়োগ দেওয়া ৭৩ শিক্ষকের নিয়োগ বাতিল করতে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ বাতিলের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ

ইউজিসির তদন্তে মেলে সত্যতা

নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে একের পর এক অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় ২০২০ সালের নভেম্বরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তদন্ত কমিটি করে ইউজিসি। এক বছরের বেশি সময় পর গত ২৩ জানুয়ারি প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত কমিটি।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, উপাচার্য নিজের ছেলে শফিউর রহমান খান ও শ্যালক জসীম উদ্দীনকে নিয়োগ দেন শাখা কর্মকর্তা পদে। আপন চার ভাতিজাকেও নিয়োগ দেন তিনি। তারা হলেন- হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে মুরাদ বিল্লাহ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে সুলতান মাহমুদ, ল্যাব টেকনিশিয়ান পদে ইমরান হোসেন ও অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে মিজানুর রহমান। শ্যালিকার ছেলে সায়ফুল্লাহ হককে নিয়োগ দেন সহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) হিসেবে। ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদে নিয়োগ পাওয়া নিজামউদ্দিনও উপাচার্যের আত্মীয়। তাদের সবাইকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়।

উপাচার্যের মেয়ে ইসরাত খানকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ইসরাত ২০২০ সালের ১৩ এপ্রিল প্রভাষক পদে আবেদন করেন। এ পদে ৩০ জন আবেদন করেন। তাদের মধ্যে স্নাতক পর্যায়ের ফলে পিছিয়ে ছিলেন উপাচার্য-কন্যা। তার সিজিপিএ ৩ দশমিক ৩০। কমিটির তদন্তে উপাচার্যের মেয়ের নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও ত্রুটি ধরা পড়ে।

শুধু মেয়েকে নয়, উপাচার্য নিজের স্ত্রীকেও সরাসরি অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রে কোনো শর্ত পূরণ করা হয়নি, বলছে তদন্ত কমিটি। এছাড়া মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ পাওয়া মো. আশিকুল আলমের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

ইউজিসি’র তদন্ত প্রতিবেদনে উপাচার্যের কন্যার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগটি ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া, স্ত্রীকে সরাসরি অধ্যাপক বানানোর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাতিল করা এবং সব নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও অঞ্চলপ্রীতি না করাসহ সাত দফা সুপারিশ করা হয়।

মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ

ইউজিসির তদন্তে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ার পর উপাচার্যের ওই নয় আত্মীয়-স্বজনের নিয়োগ বাতিল করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে বিশেষজ্ঞ ছাড়া একই ব্যক্তিদের দিয়ে বাছাই বোর্ড গঠন করে ২০টি বিষয়ে নিয়োগ দেওয়া ৭৩ শিক্ষকের নিয়োগ বাতিল করতে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ বাতিলের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুকৃবি) সাবেক উপাচার্য মো. শহীদুর রহমান খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

আরএম/জেডএস