পুলিশে যোগ দেব শুনে পরিবারের সবাই মন খারাপ করে
মাহমুদা আফরোজ লাকী
মাহমুদা আফরোজ লাকী, দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) হিসেবে। ২০১০ সালে ২৮তম বিসিএসের মাধ্যমে যোগ দেন পুলিশে। এরপর সদর দফতর ও মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার পদে কাজ করেছেন। অর্জন করেন পুলিশের সর্বোচ্চ (পিপিএম) পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার। নারী দিবস উপলক্ষে জীবনের নানা বাঁকের গল্প বলেছেন ঢাকা পোস্টকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জুনায়েদ হাবীব। অনুলিখনে ফারহাত মাইশা।
ঢাকা পোস্ট : আপনার ছোটবেলার গল্প দিয়ে সাক্ষাৎকারটি শুরু করতে চাই…
বিজ্ঞাপন
মাহমুদা আফরোজ লাকী : আমার বড় হয়ে ওঠা পুরান ঢাকায়। আমরা তিন বোন ছিলাম। বাবা-মায়ের কাছ থেকে সবসময় সমান আদর-যত্ন পেয়েছি। ছেলে না থাকায় আমার বাবা-মায়ের তেমন কোনো দুঃখ ছিল না। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আত্মীয়স্বজনদের বেশ দুঃখ ছিল। তখন থেকে ছেলের মতো বাবা-মায়ের দায়িত্ব বা অন্যান্য কাজ করে দেওয়ার চেষ্টা করতাম। দেখা যেত, বাসার প্রয়োজনীয় বাজার-সদাই, বিদ্যুৎ বিল দিতে যাওয়া থেকে শুরু করে ব্যাংকের কাজ সবই সামলাতাম। আসলেই আমি ছোটবেলা থেকে চেয়েছি বাবা-মায়ের ছেলের জায়গাটা পূরণ করতে।
ঢাকা পোস্ট : পুলিশে কীভাবে আসা, নিশ্চয়ই অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল?
বিজ্ঞাপন
মাহমুদা আফরোজ লাকী : বিসিএসে যখন আমার পুলিশ ক্যাডার আসে তখন আমি দায়িত্ব পালন করছিলাম নারায়ণগঞ্জের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে। ওইদিন গাড়িতে করে কোথাও যাচ্ছিলাম। সেখানেই জানতে পারলাম আমি পুলিশ ক্যাডারে চান্স পেয়েছি। তখন বাবাকে বিষয়টি জানালে বাবা একটু হেসে বলেন বাসায় আসো। পরে বাসায় গিয়ে দেখলাম অবাক কাণ্ড!
পরিবারের কেউ যখন পুলিশ ক্যাডারের যোগদানের খবর জানায় তখন তার পরিবার আনন্দের বন্যায় ভেসে যাওয়ার কথা। কিন্তু এক্ষেত্রে ঘটে সম্পূর্ণ উল্টো। বাবা-মায়ের ভীষণ আপত্তি। বাসার সবার মুখে শোকের ছাপ নেমে এলো! তারা আমাকে বলতে থাকল এ কাজটি বেশ কঠিন হবে আমার জন্য, আমি মেয়ে মানুষ, এ কাজ করতে পারব না। সত্য কথা হলো, আমার উচ্চতাও কম ছিল। তখন আম্মু বলল তুমি মেয়ে হয়ে কেমনে পারবে? অনেক গায়ের জোর লাগে, অসম্ভব!
সেদিন অনেক বুঝানোর পরও তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। পরে একসময় বাবা-মা বললেন, যদি যেতেই হয় যাও। কিন্তু পরে কিছু হলে আমাদের দোষ দিতে পারবে না! তখনই আমি পরিবারের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছিলাম।
ট্রেনিংয়ে চূড়ান্ত মনোনিবেশ করেছিলাম। সারদায় ট্রেনিংয়ে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিল। সারা শরীর হাত-পা ব্যথা হয়ে যেত। ট্রেনিংয়ে ১৮০ জনের মধ্যে আমি প্রথম স্থান অর্জন করেছিলাম এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে পুরস্কৃত করেছিলেন। তখন যেন এতদিনের সমস্ত কষ্ট নিমেষেই মুছে গেল। আমার বাবা অত্যন্ত গর্ব করে বলছিলেন আমার মেয়ে প্রথম হয়েছে।
ঢাকা পোস্ট : সারদায় পুলিশ প্রশিক্ষণ কঠিন একটি ধাপ। কঠিন এ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাই…
মাহমুদা আফরোজ লাকী : একটা ঘটনা শেয়ার করি, সারদায় এক মাইলজুড়ে প্রশিক্ষণের যে মাঠটা থাকে সেখানে প্রতিদিন নিয়ম করে তিন বেলা দৌড়াতে হতো। মেয়েরা তো ছেলেদের মতো দৌড়িয়ে পারত না।
তখন আমার ইচ্ছে ছিল আমি রাইড গাইড হব। রাইড গাইড হওয়া মানে আমার পেছনে সব পুরুষ থাকবে, আমি নেতৃত্ব দিয়ে সামনে থাকব, তারা আমার পেছনে পেছনে ছুটবে! আর এটাতো একটা বিশাল ব্যাপার। আমাদের প্রশিক্ষক যারা তাদের গুরুজি বলি, তো গুরুজি চাইতেন না আমি নেতৃত্বে থাকি। কিন্তু প্রচণ্ড কষ্ট সহ্য করেও নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকতাম। অবশেষে এক রাতে গুরুজি হেসে হেসে বললেন, ‘আর পারা গেল না আপনাকে নিয়ে! রাইড গাইডটা ধরেই রাখলেন!’
ঢাকা পোস্ট : পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। উল্লেখ করার মতো কোনো অভিযানের গল্প শুনব…
মাহমুদা আফরোজ লাকী : আমার প্রতিটি অভিযানই সেরা ছিল। এক মামলার আসামিকে ধরতে ঢাকার বাইরে অভিযান পরিচালনা করেছিলাম। কিন্তু আসামি প্রত্যেকবারই পুলিশ যাওয়ার খবর পেয়ে যায়। গ্রেফতার থেকে বাঁচতে পদ্মাপারে একটা বাজারে মাছ ব্যবসায়ী সাজত সে। ওইদিন আসামিকে ধরার জন্য আমাদের সবাইকে জেলের ছদ্মবেশ ধরতে হয়েছিল। তারপর আমরা আসামিকে ধরতে সক্ষম হয়েছিলাম। পরদিন ওই গ্রামে মুখে মুখে রটে গেল পুলিশ এসে আসামিকে মাছ বানিয়ে খাঁচিতে ঢুকিয়ে নিয়ে গেছে।
ঢাকা পোস্ট : পুলিশ অফিসারের বাইরে আপনি একজন মা। সংসার এবং পেশা দুটোর মধ্যে ভারসাম্য রাখেন কীভাবে?
মাহমুদা আফরোজ লাকী : সংসার ফেলে রাত-বিরাতে মাঠপর্যায়ে কাজ করা আমাদের মেয়েদের ক্ষেত্রে বেশ চ্যালেঞ্জিং। আমাকে মাসে অন্তত চারবার নাইট রাউন্ডে বের হতে হয়। সে সময়টা আমাকে ম্যানেজ করে নিতে হয়। পরিবারে আমার স্বামী এবং মা অনেক বেশি সাপোর্টিভ হওয়ায় আমি কাজ করে যেতে পারছি। আমার বোন ও আমাকে সাপোর্ট করে। আমার দুই বছরের একটা মেয়ে আছে। মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গেলে তখন আমার মা ও বোন মেয়ের দেখাশোনা করেন। প্রতিদিনই নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। যখন অফিসের উদ্দেশে বের হই তখন সবচেয়ে কষ্টকর মুহূর্তটা আমি একজন মা হিসেবে অনুভব করি। হাজার হোক মায়ের মন তো, এতটুকু বাচ্চাকে রেখে বের হই! কত কিছু বুঝাতে হয় তাকে। আজ একটু আগেই কল করে কান্না করে বলছিল, ‘সাব্বির মামাকে পাঠাও (বডিগার্ড) আমি তোমার কাছে আসব!’
ঢাকা পোস্ট : আজ নারী দিবস। বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছরে পা রেখেছে, কী বলবেন নারীর প্রতিবন্ধকতা নিয়ে?
মাহমুদা আফরোজ লাকী : আমার মতে নারী-পুরুষ উভয়ের জীবনেই প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। কোনো মানুষই প্রতিবন্ধকতার বাইরে নয়। শুধু যে পুরুষ নারীদের জীবনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন এমনটি নয়। তবে নারীদের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার জায়গাটা বেশি। আমাদের সমাজে এখনো নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়নি, আমরা এখনো অতটা সভ্য হয়ে উঠতে পারিনি, নারীর সম্পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারিনি। এখনো সমাজ থেকে নারী-পুরুষ বৈষম্য বিলোপ করতে পারিনি । প্রতিটি নারী যদি যুক্তি দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে, মেধা দিয়ে প্রমাণ করতে পারে, আমি যা করছি সেটিই ঠিক এবং এতে আমার ভালো হবে, পরিবার ও দেশের ভালো হবে, তাহলেই আমার মতে প্রতিবন্ধকতার জায়গা অনেকটাই কমে আসবে।
এমএমজে/এসকেডি