এ বছরও নাগরিকের মতপ্রকাশ এবং শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হওয়ার ও প্রতিবাদ করার সাংবিধানিক অধিকার বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার অব্যাহত রয়েছে। ২০২২ সালের বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পর্যবেক্ষণে এ তথ্য উঠে এসেছে। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নতির জন্য ১৪ দফা সুপারিশ তুলে ধরেছে সংগঠনটি।

শনিবার (৩১ ডিসেম্বর) সংগঠনটির লালমাটিয়া কার্যালয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন আসকের সিনিয়র সমন্বয়ক আবু আহমেদ ফয়জুল কবীর। 

পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সারা বছরের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, গত বছরের মতো এ বছরও নাগরিকের মতপ্রকাশ এবং শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হওয়ার ও প্রতিবাদ করার সাংবিধানিক অধিকার বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার অব্যাহত রয়েছে। যদিও বছরের শুরুতে আইনমন্ত্রী এ আইনে কারো বিরুদ্ধে মামলা হলে তা তদন্তের জন্য নির্ধারিত সেলে পাঠাতে হবে এবং কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে গ্রেপ্তার করা যাবে না বলে ঘোষণা দেন। তবুও এ আইনে মামলা ও গ্রেপ্তার অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া আইনমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজনে এ আইন সংশোধন করা হবে বলে উল্লেখ করেছেন এবং এ লক্ষ্যে সরকার জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ের সঙ্গে কাজ করছে, ইতোমধ্যে ছয় সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠিত হয়েছে বলে জানালেও এখন পর্যন্ত আইনটি সংশোধনের ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। বরং আইনটির অপব্যবহার বিপজ্জনকভাবে বেড়েই চলেছে।

জিনিসপত্রের অবিরাম মূল্যবৃদ্ধির ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। দ্রব্যমূল্য গত এক বছরে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ বেড়েছে। অথচ নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠী ছাড়া কারো আয় বাড়েনি। কৃষকের ফসলের দাম নেই, গার্মেন্টসসহ শ্রমিকদের মজুরি আয়ের নিম্নমাত্রাতেই আটকে আছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের অনিশ্চয়তা আরও বেড়েছে। এর মধ্যে মানুষ টিকে থাকার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে। 

সংবাদ সম্মেলনে আসক সরকারের প্রতি ১৪ দফা সুপারিশ তুলে ধরেছে— 

১. শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। এ অধিকার যথাযথভাবে চর্চা করার পরিবেশ তৈরি এবং জনদুর্ভোগ এড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

২. গণমাধ্যম ও নাগরিকদের মতপ্রকাশের অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনতে হবে। সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত এ আইনে মামলা গ্রহণ না করার নির্দেশনা প্রদান করতে হবে।

৩. রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা যেকোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যেমন— বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুমের অভিযোগ, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এখতিয়ার বহির্ভূত আচরণ ইত্যাদির অভিযোগ উঠলে তা দ্রুত নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে হবে এবং সম্পৃক্তদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে শাস্তি প্রদান করতে হবে।

৪. এ পর্যন্ত সংঘটিত সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তদন্তে নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে দেশের যেকোনো নাগরিককে আটক বা গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা সম্পূর্ণভাবে মেনে চলতে হবে এবং এর ব্যত্যয় ঘটলে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

৫. নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত করতে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক আইনগুলোতে পরিবর্তন আনতে হবে। নারীর অধিকার সম্পর্কে সর্বস্তরের জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে। শিক্ষা কারিকুলামে সমমর্যাদা, সমানাধিকার, বৈষম্যহীতা, বৈচিত্র্যতার প্রতি সম্মান প্রভৃতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

৬. নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে এবং প্রতিকার বিধানে ভুক্তভোগী ও ‘সাক্ষী সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ন করতে হবে। ২০০৭ সালে আইন কমিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত ‘ক্রাইম ভিকটিম কম্পেনসেশন অ্যাক্ট’ আইনে পরিণত করতে হবে। 

৭. ‘সাক্ষ্য আইন (সংশোধন) বিল, ২০২২’ দ্রুততার সঙ্গে গেজেট আকারে প্রকাশ এবং এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের ঘটনার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের ১৮ দফা নির্দেশনা সুস্পষ্টভাবে মেনে চলা এবং এর ব্যত্যয় ঘটলে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ নির্দেশনা ব্যাপকভাবে প্রচার করা এবং দায়িত্ববাহকদের যথাযথভাবে জানানো ও সংবেদনশীল করে তুলতে হবে। আইন ও বিচারিক কাঠামো নারীবান্ধব করতে হবে। 

৮. ধর্মীয় উত্তেজনা তৈরি করে কোনো সহিংসতার ঘটনা না ঘটে তার জন্য পর্যাপ্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিজ বিশ্বাস ও রীতি চর্চার অধিকার এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। 

৯. মানবাধিকারকর্মী ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯ দ্রুততার সঙ্গে সংশোধন করতে হবে। কমিশনের প্রধান ও সদস্যদের নিয়োগের জন্য একটি উন্মুক্ত ও অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। 

১০. পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

১১. কাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মানবাধিকার সুনিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

১২. দেশে সুস্থ রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করার মাধ্যমে নাগরিকদের অধিকার ভোগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

১৩. অভিবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা ও সহযোগিতায় বিদেশে দূতাবাসগুলোতে জরুরি হেল্পলাইন নম্বর চালুসহ অন্যান্য কল্যাণমূলক ব্যবস্থা বিস্তৃত করতে হবে। 

১৪. সাধারণ জনগণের জন্য রেশন কার্ড চালু করতে হবে। 

সংবাদ সম্মেলনে আসকের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন ও পরিচালক অ্যাডভোকেট নীনা গোস্বামী উপস্থিত ছিলেন।

এমএইচডি/এসএসএইচ/