ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক রাজনীতিতে এখন বিভক্তি চলছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা, অন্যদিকে রাশিয়া-চীন। পরাশক্তিদের এ মেরুকরণ আরও দীর্ঘায়িত হওয়ার আভাস মিলছে। ফলে চলতি বছরও খাদ্য, জ্বালানি, অর্থনৈতিক সংকটসহ আরও নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বিশ্বকে।

ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান, ভারসাম্য কূটনীতিতে অটল থাকা, দেশের খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি অর্থনীতির চাকা সচল রাখা এবং ২০২৪ সালের শুরুতে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে চলতি বছর কূটনীতিতে নানা চ্যালেঞ্জ দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বৈশ্বিক রাজনীতিতে অস্থিরতা চলমান থাকুক, সেটি চায় না বাংলাদেশ। পরিস্থিতি বিবেচনায় পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য বজায় রাখতে চায় সরকার। কোনো পক্ষকে সমর্থন করে অন্য পক্ষের সঙ্গে বিরোধে জড়ানোর ইচ্ছেও নেই ঢাকার। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে অর্থনৈতিক কূটনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার কৌশল নিয়েছে সরকার। পাশাপাশি বিদেশে বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার বন্ধে তৎপরতা বজায় রাখবে সরকার। 

আরও পড়ুন : লু’র ঢাকা সফর: বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের যত চাওয়া

মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে অর্থনৈতিক কূটনীতির বিষয়টি সামনে এনেছেন। ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অর্থনীতি সচল রাখা বড় চ্যালেঞ্জ। সেজন্য অর্থনৈতিক কূটনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার কৌশল নিয়েছে সরকার। এসডিজি অর্জন নিশ্চিত করার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গা সমস্যা আছে, জলবায়ু ইস্যু আছে। তাছাড়া বিদেশে বাংলাদেশ নিয়ে যেসব মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য প্রচার হচ্ছে, সেগুলো যেন না হয়; সেটার ওপর বেশ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কেননা, একটি মহল কিন্তু বিদেশে এসব অপপ্রচারের মাধ্যমে দেশের সম্মান নষ্ট করছে।

চলতি বছর সরকারের কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং তা থেকে উত্তরণ পরিকল্পনা নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে কথা হয়েছে ঢাকা পোস্টের।

আরও পড়ুন : চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দূতদের প্রস্তুত থাকার বার্তা দেবে ঢাকা

কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিশ্বজুড়ে একটা অস্থিরতা আছে। আমাদের অবস্থানও খুব পরিষ্কার। আমরা অস্থিরতা চাই না, আমরা চাই শান্তি। চ্যালেঞ্জের মধ্যে আমরা অর্থনৈতিক কূটনীতিটাকে আরও গুরুত্ব দিতে চাই। নতুন চ্যালেঞ্জ আছে- বিদেশে মিথ্যা প্রচারণা হচ্ছে, এটাও একটা চ্যালেঞ্জ। আমরা এ বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে চাই। আমরা আমাদের মিশন প্রধানদের বলে দিয়েছি, এ বিষয়ে অ্যাকশন নিতে।

তিনি বলেন, আমরা প্রবাসে দেখি, অনেক অনেক গণমাধ্যমে এখনও বাংলাদেশ নিয়ে ভুল ধারণা আছে। তারা এখনও মনে করে আমরা সেই ৭৩ সালেই আছি। বিদেশিদের এসব ভুল ভেঙে দেওয়ার দায়িত্ব সবাইকে নিতে হবে।

পুরনো চ্যালেঞ্জেও সরকারের মনোযোগ দিতে হবে বলে জানান মন্ত্রী। মোমেন বলেন, আমাদের পুরনো ট্রেডিশনাল চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন, গেইনফুল এমপ্লয়মেন্ট, আমার ট্রেড বাড়ানো, ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট আনা চ্যালেঞ্জ। এগুলো পুরোনা চ্যালেঞ্জ।

আরও পড়ুন : প্রত্যাবাসন বহু দূর, সীমান্তে নজর রাখতেই বছর পার

নতুন এবং পুরনো সব চ্যালেঞ্জ সরকার ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারবে বলে বিশ্বাস করেন ড. মোমেন। তার ভাষায়, এসব চ্যালেঞ্জ আমাদের মোকাবিলা করতে হবে এবং আশা করছি, খুব ভালোভাবেই এসব চ্যালেঞ্জ আমরা মোকাবিলা করতে পারব।

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনকে সামনে রেখে সদ্য শেষ হওয়া বছরের শেষ প্রান্তিকে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে পশ্চিমারা। এ বছর পশ্চিমারা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে সরব থাকবে বলেই ধারণা করছেন অনেকেই।

নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমাদের সামলানো সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হবে কিনা- জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ওটা নিয়ে আপনাদের (গণমাধ্যম) বেশি মাথা ব্যথা। আপনাদের মাথা ব্যথা দেখেই তাদেরও মাথা ব্যথা। আপনারা সুযোগ দেন বলেই, তারা কথা বলে। ওদের থেকে বেশি মাথা ব্যথা আপনাদের।

আরও পড়ুন : ইইউর সঙ্গে সম্পর্ক নতুন কলেবরে নিতে চায় ঢাকা

এ সময় যুক্তরাষ্ট্রে থাকার অভিজ্ঞতার তুলে ধরেন মোমেন। তিনি বলেন, আমি আমেরিকায় এত বছর ছিলাম। সেখানে মাস দেড়েক বা দুয়েক আগে নির্বাচন নিয়ে কেউ কথা বলে না। কিন্তু আমাদের এখানে অনেক আগেই শুরু হয়ে যায়।

ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান, ভারসাম্য কূটনীতিতে অটল থাকা, দেশের খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি অর্থনীতির চাকা সচল রাখা এবং ২০২৪ সালের শুরুতে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে চলতি বছর কূটনীতিতে নানা চ্যালেঞ্জ দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিদেশিরা বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গে কথা বললে দেশের গণমাধ্যমকে প্রত্যাখ্যান করার পরামর্শ দিয়েছেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, তারা (বিদেশিরা) কিছু বললে আপনারা (গণমাধ্যম) এগুলো প্রত্যাখ্যান করেন। দেখবেন ওরা চুপ হয়ে যাবে। আর তারা আমাদের গণতন্ত্র, মানবাধিকার শেখাবে? তাদের দেশে লোকে-তো ভোটই দেয় না। আমাদের এখানে সবাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। আর তারা আসে আমাদের শেখাতে।

নির্বাচন ছাড়াও পশ্চিমারা গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, শ্রম অধিকার, গুম-খুনের বিষয়ে কথা বলতে প্রতিনিয়ত সরব থাকছে, এ ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থান কী, জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তারা (বিদেশিরা) আমাদের মানবাধিকার শেখাতে আসে। যখন রোহিঙ্গাগুলো কষ্টে ছিল, তখন মানবাধিকার নিয়ে যারা কথা বলে সামনে আসছিল? বাংলাদেশ এগিয়ে গেল। মানবাধিকার গুরুত্ব দেয় বাংলাদেশ। আমাদের ৩০ লাখ লোক গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের জন্য রক্ত দিয়েছে। পৃথিবীর কোথাও আছে এটা? আর তারা (বিদেশিরা) আমাদের এসব বোঝাতে আসে!

এনআই/এমজে/এসকেডি