মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে মাস খানেকেরও বেশি সময় ধরে সীমান্তে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। দেশটির রাখাইন রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর হামলার ঘটনায় বাংলাদেশ সীমান্তে কখনো মর্টার শেল, কখনো গোলা এসে পড়ছে। এতে প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটছে। যা বাংলাদেশের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আভ্যন্তরীণ সংঘাত হোক বা অন্য কোনো কারণে হোক, এ ইস্যুতে মিয়ানমার যাতে কোনো ফায়দা লুটতে না পারে, সেজন্য বিদেশি বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানিয়ে সহযোগিতা চেয়েছে ঢাকা। ঢাকার আমন্ত্রণে বেশিরভাগ বিদেশি বন্ধুরা সাড়া দিলেও চীনের অনুপস্থিতি নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বা প্রতিনিধি না থাকাকে অন্য ব্যাখ্যায় নেওয়া ঠিক হবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। চীনের না আসা নিয়ে অন্য কোনো কারণ খুঁজতে গেলে ক্ষতিটা বাংলাদেশেরই হবে বলে মনে করছেন তারা। তারা বলছেন, ঢাকা চাইলে চীনকে নিয়ে আলাদাভাবে বসতে পারবে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে নিয়ে ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ একমাত্র চীনই নিয়েছে বলেও মনে করিয়ে দেন বিশ্লেষকরা।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, চীন চুপ রয়েছে কিংবা ব্রিফিংয়ে আসেনি বলে এটাকে অন্যভাবে দেখা ঠিক হবে না। কখনো কখনো সম্মিলিত মিটিং হলে, যেখানে ইউরোপীয়ানরা হাজির হয়; যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া থাকে; সেখানে ভারত, চীন ও রাশিয়া থাকতে চায় না। সে কারণে চীনের না আসাটা ব্যতিক্রম নয়। চীনকে আলাদা করা হলে এটা ক্ষতি হবে। বরং চীন একমাত্র দেশ যে একটা প্ল্যান দিয়েছে, ত্রিপক্ষীয় মিটিং করেছে, যেটা অন্য কোনো দেশ করেনি।

অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ পশ্চিমাদের ইঙ্গিত করে বলেন, তারা কথা বলে ভালো। সুন্দর লাগে কথা বলতে। কিন্তু চীন যেমন মিয়ানমারে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে, তারাও করছে। দুটোর মধ্যে তফাৎটা হলো, চীন কখনো পাবলিকিলি কিছু বলে না। অন্য দেশগুলো মুখে বলে বেড়ায় মিয়ানমার এটা করছে, ওটা করছে, বাংলাদেশকে আমরা সমর্থন করছি। আদতে দুই পক্ষই কিন্তু মিয়ানমারে ব্যবসা করছে। বরং কোনো ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ অন্যরা নেয়নি, চীন নিয়েছে।

আরও পড়ুন : সীমান্ত সংকট ও মিয়ানমারের সামরিকায়ন : কী করছে বিশ্ব? 

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এ বিশ্লেষক বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তো ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ নিতে পারে, তাদের তো ওখানে রাষ্ট্রদূত বসে আছে। তাই বিষয়টাকে ওভাবে দেখা ঠিক নয়। ভুল মেসেজ যাবে। যেটা দেখা দরকার, বাংলাদেশ যাদের সঙ্গে বসেছে, ঠিক একইভাবে আমি মনে করি, বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে যদি আলাদা বসতে হয় বসবে। এ ব্যাপারে সবার সঙ্গে একসঙ্গে বসতে হবে এটা মূল বিষয় নয়। মূল হলো আমি আমার বার্তাটা সবাইকে পৌঁছে দিতে পারছি কি না। 

রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সেখানকার সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সংঘাতের জেরে বাংলাদেশের ঘুমঘুম সীমান্তের পরিস্থিতি এবং এর কারণে বাংলাদেশ যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, সেগুলো জানাতে গত সোমবার (১৯ সেপ্টেম্বর) প্রথম দফায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে আসিয়ান জোটের দূতদের ডাকা হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে সেই ব্রিফিংয়ে ঢাকায় মিশন না থাকা লাওস ও কম্বোডিয়া বাদ দিয়ে মিয়ানমার ছাড়া অন্য সাত দেশের কূটনীতিকরা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে আসিয়ানের সহযোগিতা চেয়েছে ঢাকা।

পরদিন ঢাকায় নিয়োজিত পশ্চিমা ও অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রদূতদের একই ভেন্যুতে ডেকে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম বিষয়টি সম্পর্কে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ব্রিফিংয়ে বিভিন্ন দেশের প্রায় ৩০ জনের মতো রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন। এদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং আরব বিশ্বের দূতরা উপস্থিত ছিলেন। তবে ব্রিফিংয়ে চীনের কোনো প্রতিনিধি আসেননি।

আরও পড়ুন : রোহিঙ্গা : কূটনীতির সুফল মিলবে কবে? 

চীনের কোনো প্রতিনিধি না থাকার কারণ জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা তো আমন্ত্রণ পাঠিয়েছি। কেন আসেনি সে কারণ তারা জানায়নি। আমরা জানার চেষ্টা করব। আর আমরা চাইলে তাদের সঙ্গে আলাদা করেও বসা যেতে পারে বা আমরা বসতে পারব।

জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত মুনশি ফায়েজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘাত চলছে। যেহেতু সীমান্তবর্তী এলাকায় সংঘাত হচ্ছে, সে কারণে আমাদের এখানে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এটা আমাদের দিক থেকে গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু আমরা কি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ব? নিশ্চয়ই তা নয়। মিয়ানমার বলছে, স্ট্রে, বুলেট তারা ইচ্ছে করে বাংলাদেশে মারছে না। তারা ইচ্ছে করে মারছে নাকি সংঘাতের কারণে হচ্ছে তার প্রমাণও আমাদের কাছে নেই।

চীনে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা এ কূটনীতিক বলেন, কথা হলো তারা যদি আমাদের সঙ্গে যুদ্ধই করতে চায় দু’একটা বুলেট মারবে না। তাহলে ওই চিন্তাটা করা ঠিক হবে না যে তারা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চায় বা জড়াতে চায়।

সীমান্ত পরিস্থিতির কারণ হিসেবে তৃতীয় কোনো দেশকে না টানার পরামর্শ দেন মুনশি ফায়েজ। তিনি বলেন, এখানে তৃতীয় কোনো দেশকে দোষ দেওয়া ঠিক হবে না। হয়তো কোনো কারণে কূটনীতিকদের বিফ্রিংয়ে উপস্থিত হতে পারেনি চীন। এর মধ্যে অন্য কিছুকে টেনে আনা ঠিক না। তবে যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা জানতে অপেক্ষা করতে হবে। চীনের সঙ্গে আমাদের প্রতিনিয়ত দেখা-সাক্ষাৎ হচ্ছে। সুবিধামতো সময়ে তারা হয়তো ব্রিফ করবে।

আরও পড়ুন : সীমান্তে গোলাবর্ষণ, রোহিঙ্গা শিবিরে সন্ত্রাসী দল ও আমাদের করণীয়

সাবেক এ রাষ্ট্রদূত বলেন, হতে পারে তাদের (চীনের) নিজস্ব ব্যস্ততায় আসতে পারেনি। উপস্থিত না হওয়ার জন্য অন্য কোনো কারণ খোঁজা ঠিক হবে না। আমাদের আরেকটু দায়িত্বশীল হতে হবে। অপেক্ষা করতে হবে। আর চীন না আসায় আমাদের তো কোনো ক্ষতি হয়নি। যেহেতু তারা আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে অনেক সাহায্য করার চেষ্টা করেছে, যদিও সেটার সফলতা আসেনি। কিন্তু চেষ্টা করেছে। অন্য কোনো দেশ কিন্তু সেই চেষ্টাটাও করে দেখায়নি।

বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশের করণীয় জানতে চাইলে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদের ভাষ্য, আমরা কূটনীতিকদের নিয়ে বসেছি। এটাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া দরকার। যদি প্রয়োজন হয় নিরাপত্তা পরিষদে এটা ওঠানো যেতে পারে। এ জিনিসগুলো বাড়ানো উচিত। কারণ হচ্ছে আমরা যদি চুপ করে থাকি স্বাভাবিকভাবে এ সুযোগটা মিয়ানমার পাবে।

একই প্রশ্নের জবাবে সাবেক রাষ্ট্রদূত মুনশি ফায়েজ বলছেন, চীনের দোষ না দিয়ে তাদের কীভাবে কাছে টানা যায় সেই চেষ্টা করা দরকার এবং তাদেরকে নিয়ে কিছু করা যায় কি না সেই চেষ্টা করতে হবে। চীনকে কাজ লাগাতে হবে। সঙ্গে অন্যদেরও কাজে লাগাতে হবে।

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তে গত শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে নতুন করে গোলাগুলি শুরু হয়। ওইদিন রাত ৮টার দিকে একটি মর্টার শেল এসে তুমব্রু সীমান্তের বিপরীতে শূন্যরেখায় পড়ে। এতে এক রোহিঙ্গা যুবকের মৃত্যু হয়।

ওই ঘটনায় এক শিশুসহ কয়েকজন রোহিঙ্গা নাগরিক আহত হন। পরে রোববার মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়ে-কে ডেকে কড়া প্রতিবাদ জানায় ঢাকা। রাষ্ট্রদূতকে একটি প্রতিবাদলিপি দেওয়া হয়।

এর আগে কয়েক দফায় মিয়ানমার থেকে মর্টারশেল ও গোলা এসে পড়ে বাংলাদেশের ভেতরে। ওইসব ঘটনায়ও মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে প্রতিবাদ জানানো হয়।

এনআই/জেডএস