‘লাখ লাখ মুসল্লি একসঙ্গে অবস্থান করবো, ইবাদত করবো, আখেরি মোনাজাতে অংশ নেবো- এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে? তাইতো জেঁকে বসা শীত, রাস্তার ভোগান্তি সব কিছুই উপেক্ষা করে আল্লাহর দরবারে নিজেকে সঁপে দিতে এসেছি।’

ইজতেমা ময়দানে কথাগুলো বলছিলেন সিরাজগঞ্জ থেকে আসা আলহাজ্ব আব্দুস সোবহান। ইজতেমা শুরুর দুই দিন আগেই ১৩ জন মুসল্লিকে সঙ্গে নিয়ে তুরাগ পাড়ে হাজির হয়েছেন তিনি। থাকছেন ইজতেমা ময়দানের ২৯ নম্বর খিত্তায়।

শীত উপেক্ষা করেই হাঁটছেন মুসল্লিরা, লক্ষ্য তুরাগ তীর

সরেজমিনে ইজতেমা ময়দানে গিয়ে দেখা যায়, আব্দুস সোবহানের মতো অসংখ্য মুসল্লি শীত উপেক্ষা করে জড়ো হচ্ছেন এই ইজতেমা প্রাঙ্গণে। মাঠে যতদূর চোখ যায় ততদূর পর্যন্তই শুধু মুসল্লিদের ঢল। সবারই লক্ষ্য যেন লাখো মুসল্লির কাতারে শরিক হয়ে পরম করুণাময়ের দরবারে হাত পাতা। ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের লাইন কোথা থেকে শুরু হয়েছে আর কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, তা ভুলে গিয়েছেন স্বয়ং খোদাপ্রেমী এসব মানুষেরা। দল বেধে আসছেন তারা, কেউ এসেছেন হাঁটা পথে, কেউ বা বাস, ট্রেন, ট্রাকে বা গাড়িতে করে। তাদের লক্ষ্য যেন রাজধানীর উপকণ্ঠের তুরাগ তীর। সেই লক্ষ্য নিয়েই এগিয়ে চলছেন ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা।

ইজতেমায় অংশগ্রহণই যেন মুসল্লিদের মূল উদ্দেশ্য

আগামীকাল শুক্রবার ফজরের নামাজের পর গাজীপুরের টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা মাঠে শুরু হচ্ছে তাবলিগ জামাতের সবচেয়ে বড় আসর তাবলিগে ইজতেমা। আর রোববার আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত চলবে তাবলীগের ৬ উসুলের বয়ান। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের বিশিষ্ট আলেমগণ বয়ান করবেন। মূল বয়ান বাংলাসহ বিভিন্ন ভাষা-ভাষীদের জন্য অনুবাদ করা হবে।

ঢাকা-গাজীপুরের প্রতিটি সড়ক-মহাসড়ক, আশপাশের অলি-গলির মুসল্লিরাও যেন মিশে গেছে ইজতেমা ময়দানে। যেন তিল ধারণের ঠাঁই নেই কোথাও।

এদিকে ইজতেমায় যোগ দিতে গত দুই দিন ধরেই ইজতেমা মাঠে আসতে শুরু করেছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসল্লিরা। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এসেও মুসল্লিরা যোগ দিয়েছেন এই কাফেলায়। তবে আজ সকাল থেকে মুসল্লিদের ঢল নেমেছে সবচেয়ে বেশি।

শুধু ইজতেমা ময়দানই নয় বরং এই এলাকার রাস্তাঘাট-অলিগলিতেও ছেঁয়ে গেছে মুসল্লি। সবাই যেন একই পথের পথিক, আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে সবাই যেন পাগলপারা। সব বিভেদ ভুলে ইজতেমায় অংশগ্রহণই যেন সবার মূল উদ্দেশ্য।

এদিকে করোনার কারণে গত দু'বছর ইজতেমা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় এবার ৫৭তম তাবলীগের এ মহাসম্মেলনে যোগ দিতে আগেভাগেই উপস্থিত হচ্ছেন মুসল্লিরা। ময়দানে আসা মুসল্লিদের জমিয়ে রাখতে বৃহস্পতিবার বাদ ফজর থেকে শুরু হয়েছে প্রাথমিক বয়ান। বিশাল মাঠটিকে বাঁশের খুঁটির ওপর চটের ছাউনির প্যান্ডেলে লাগানো হয়েছে বিশেষ ছাতা মাইক। বসানো হয়েছে পর্যাপ্ত বৈদ্যুতিক বাতি।

একদিন আগেই ১৬০ একর জায়গার বিশাল ময়দানে শামিয়ানা টানানো স্থান যেন মুসল্লিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এছাড়া আশেপাশের এলাকাতেও প্রচুর পরিমাণে মুসল্লিদের ঢল দেখা যায়। ঢাকা-গাজীপুরের প্রতিটি সড়ক-মহাসড়ক, আশপাশের অলি-গলির মুসল্লিরাও যেন মিশে গেছে ইজতেমা ময়দানে। যেন তিল ধারণের ঠাঁই নেই কোথাও।

এবারের ইজতেমায় ৯১ খিত্তা

এবারের ইজতেমায় দেশের মুসল্লিদের জন্য জেলাভিত্তিক আলাদা ৯১টি খিত্তা বা ভাগ করা হয়েছে। শীত উপেক্ষা করে মঙ্গলবার রাত থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মুসল্লিরা ইজতেমা ময়দানে নির্ধারিত খিত্তায় এসে অবস্থান নিচ্ছেন।

টুঙ্গীর আহসান উল্লাহ জেনারেল হাসপাতাল সংলগ্ন ইজতেমা মাঠের একটি গেটের সামনে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আগত মুসল্লিদের সহযোগিতা করছিলেন তৌহিদুল ইসলাম নামে এক যুবক। তিনি বলেন, আমরা স্থানীয় মাদ্রাসার ছাত্র তাই আমরা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে মুসল্লিদের সহযোগিতা করছি। ইতোমধ্যে ইজতেমা মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে। এরপরও আরও মুসল্লি আসছেই। মুসল্লিদের পথ দেখাতে, কোন দিকে কোন খিত্তা, কোনটা কোন গেট, অযুখানা কোনদিকে এসব বিষয়ে মুসল্লিদের সহযোগিতা করছি আমরা।

তিনি আরও জানান, গত দুই দিন ধরেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুসল্লিরা আসছেন। তবে আজ আগত মুসল্লিদের সংখ্যা অনেক বেশি। যানজটের কারণে সারাদিন ধরেই প্রধান সড়ক স্থবির হয়ে ছিল। যে কারণে দূর দূরান্তেই মুসল্লিরা বাস থেকে নেমে পায়ে হেঁটে ইজতেমা ময়দানে আসা শুরু করেছেন। তবুও কোন মানুষের মধ্যে বিন্দুমাত্র ক্লান্তিবোধ দেখছি না।

পুরো ইজতেমা ময়দান মুসল্লিতে পূর্ণ

বিশ্ব ইজতেমার আয়োজক কমিটির সদস্য প্রকৌশলী আব্দুন নূর জানান, দেশি-বিদেশি মুসল্লিরা আসতে শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে মুসল্লিতে পুরো ইজতেমা ময়দান পূর্ণ হয়ে গেছে। শুক্রবার থেকে মূল পর্ব শুরু হলেও বৃহস্পতিবার বাদ ফজর থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে আম বয়ান।

ইজতেমা ময়দানে যেসব সুবিধা পাচ্ছেন মুসল্লিরা

মুসল্লিদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ইজতেমা ময়দানে ৫টি ক্যাম্প স্থাপন করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এখান থেকে ২৪ ঘণ্টা মুসল্লিদের বিনামূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়াও ৩১টি টয়লেট বিল্ডিং স্থাপন করা হয়েছে, যা একসঙ্গে ৯ হাজার মুসল্লি ব্যবহার করতে পারবেন।

এছাড়াও মুসল্লিদের আনা নেওয়ার জন্যও বিশেষ বাস-ট্রেন সার্ভিসের ব্যবস্থা করেছে বিআরটিসি এবং বাংলাদেশ রেলওয়ে। একইসঙ্গে মুসল্লিদের পারাপারের জন্য তুরাগ নদীর ওপর ৫টি ভাসমান সেতু নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

ইজতেমার নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১০ হাজার সদস্য

ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পোশাকে, সাদা পোশাকে পুলিশসহ দায়িত্বে আছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ১০ হাজার সদস্য। এছাড়াও ১৪টি কন্ট্রোল রুম তৈরি করেছে গাজীপুর মেট্টোপলিটন পুলিশ। এর মধ্যে র‍্যাবের কন্ট্রোল রুম থাকবে। একইসঙ্গে ডিএমপির কন্ট্রোল রুম, ওয়াচ টাওয়ার, রুফটপ ডিউটিসহ সিআইডি, নৌ-পুলিশ, অবজারভারভেশন টিম রয়েছে। এছাড়াও নিয়োজিত থাকছে র‍্যাবের হেলিকপ্টার টহল, ডগ স্কোয়াড টিম, মোবাইল পেট্টোল টিম, বোম ডিস্পোজাল টিম।

বসানো হয়েছে র‍্যাব পুলিশের কন্ট্রোল রুম

এর আগে বুধবার বিশ্ব ইজতেমা মাঠের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং বিদেশি মেহমানদের আবাসস্থল পরিদর্শন করেছেন ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এসময় তিনি বলেন, বিশ্ব ইজতেমা নিরাপদে ও সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের লক্ষ্যে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পুলিশ, র‍্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন সকলের সাথে সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে আমরা একযোগে কাজ করছি।

পুলিশ প্রধান বলেন, ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার্থে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি), গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি) এবং ঢাকা জেলা পুলিশ বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। একইসঙ্গে বিভাগ অনুযায়ী গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইজতেমা মাঠের নিরাপত্তায় এখানে ওয়াচ টাওয়ার, কন্ট্রোল রুম রয়েছে। খিত্তাভিত্তিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও নিরাপত্তা টহলে নিয়োজিত থাকবে র‍্যাবের হেলিকপ্টার।

প্রসঙ্গত, এ বছরও দুই পর্বে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রথম পর্ব সমাপ্তির পর ৫ দিন বিরতি দিয়ে দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা আগামী ২০শে জানুয়ারি শুরু হবে। আগামীকাল প্রথম পর্বে ১৩ থেকে ১৫ই জানুয়ারির ইজতেমায় অংশ নিচ্ছেন মাওলানা জোবায়ের আহমেদের অনুসারীরা। পরবর্তীতে আগামী ২০ জানুয়ারি ফজর থেকে দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমায় অংশ নিবেন মাওলানা সাদ আহমাদ কান্ধলভীপন্থি মুসল্লিরা। ২২ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে শেষ হবে দ্বিতীয় পর্বের বিশ্ব ইজতেমা।

এএসএস/এমজে