চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের পর টনক নড়েছে প্রশাসনের। এতদিন চুক্তির অজুহাতে রোগীদের জন্য হাসপাতালে নতুন করে স্থাপন করা হয়নি ডায়ালাইসিস মেশিন।

তবে গত মঙ্গলবার সংঘর্ষ ও মামলা দায়েরের পরদিন বুধবার হাসপাতালে ১০টি ডায়ালাইসিস মেশিন আসে। সেখান থেকে নতুন একটি মেশিন ইতোমধ্যে চালু করা হয়েছে। বাকি মেশিনগুলো ১৫ দিনের মধ্যে স্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

এছাড়া হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে থাকা তিনটি মেশিনও উন্মুক্ত করা হয়েছে। আবার হাসপাতালের তৃতীয় তলার নেফ্রোলজি ওয়ার্ডে আগে থেকে ১০টি মেশিন ছিল। এর মধ্যে চারটি সচল রয়েছে। এগুলোতে এখন অন্তর্বিভাগের পাশাপাশি এতদিন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যারা ডায়ালাইসিস করাতেন তাদেরও করানো হচ্ছে। সবমিলিয়ে বৃহস্পতিবার (১২ জানুয়ারি) পর্যন্ত মেশিন সচল রয়েছে আটটি। পুরনো ও নতুন যেসব মেশিন স্থাপন করা হবে সেগুলোতে রোগীরা ছয় মাসে ২০ হাজার টাকা দিয়ে ডায়ালাইসিস করাতে পারবেন।

আরও পড়ুন : জামিন পাননি মোস্তাকিম, কারা ফটকে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ

চিকিৎসকরা জানান, সাধারণত কিডনি রোগীদের সপ্তাহে দুই বার (সেশন) ডায়ালাইসিস করাতে হয়। ছয় মাসে একজন রোগীকে মোট ৪৮ বার সেশন ডায়ালাইসিস করাতে হয়। এ হিসেবে প্রতি সেশনের মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৪১৭ টাকা। যেটি এতদিন ধরে হাসপাতালে চালু থাকা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্যান্ডরের ভর্তুকি মূল্যের চেয়েও কম।

আবার মন্ত্রণালয় থেকে আসা সবগুলো মেশিন চালু হলে চমেক হাসপাতালে মেশিনের সংখ্যা দাঁড়াবে ১৭টি। একজন রোগীকে ডায়ালাইসিস করাতে সময় লাগে দুই থেকে চার ঘণ্টা। একটি মেশিনে একদিনে সাধারণত তিনজন তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ চারজন পর্যন্ত ডায়ালাইসিস করানো যায়। এতে চমেক হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে সুলভ মূল্যে একদিনে প্রায় ৫১ থেকে ৬৮ জন রোগী সেবা পেতে পারবেন। যাদের সবাইকে এতদিন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্যান্ডরের ওপর নির্ভর করতে হতো।

বৃহস্পতিবার (১২ জানুয়ারি) বিকেলে চমেক হাসপাতালের তৃতীয় তলায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে নতুন করে আসা ডায়ালাইসিস মেশিন বসানোর কাজ চলছে। দুটি কক্ষ ভেঙে একটি করা হয়েছে। সেখানে কর্তব্যরত কর্মকর্তারা জানান, কিছুদিনের মধ্যে মেশিন স্থাপনের কাজ শেষ হবে এবং রোগীদের ভোগান্তি কমবে।

আরও পড়ুন : চমেক সংঘর্ষে ওসির বাড়াবাড়ি, ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ দেখছেন অনেকে

জানা গেছে, চমেক হাসপাতালে এতদিন ধরে নিচতলায় স্থাপিত ভারতীয় প্রতিষ্ঠান স্যান্ডরে ডায়ালাইসিস করাতেন রোগীরা। এখানে মোট ৩১টি মেশিনে ভর্তুকি এবং বেসরকারি দুটি মূল্যে রোগীরা ডায়ালাইসিস করাতেন। চমেক হাসপাতালের পরিচালক এবং উপ-পরিচালকের সুপারিশ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি এতদিন ধরে ভর্তুকি মূল্যে প্রতি সেশনে ৫১০ টাকা ও বেসরকারিভাবে ২ হাজার ৭৮৫ টাকা করে নিত। কিন্তু এখন ভর্তুকি মূল্য বেড়ে ৫৩৫ ও বেসরকারিভাবে ২ হাজার ৯৩৫ টাকা হয়েছে। পাশাপাশি আগে যারা সবগুলো সেশন ভর্তুকি মূল্য পেতেন এখন তাদের এই সুবিধা অর্ধেক করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিমাসে আগে ৮ সেশন ভর্তুকি মূল্যে করানো গেলেও এখন ৪ সেশন করাতে পারেন। বাকি অর্ধেক বেসরকারি মূল্যে করাতে হবে।

আরও পড়ুন : চমেকে রোগীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ, আটক ১

এ নিয়ে চলতি বছরের শুরুতে চমেক হাসপাতালে রোগী ও তাদের স্বজনরা আন্দোলনে নামেন। এরই অংশ হিসেবে মঙ্গলবার (১০ জানুয়ারি) বিক্ষোভকারীরা চমেকের প্রধান ফটকের সামনের সড়ক অবরোধ করেন। এদিন পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে আন্দোলনকারীদের সড়ক ছেড়ে দিতে অনুরোধ করে। কিন্তু আন্দোলনকারীরা সড়ক না ছাড়ার ঘোষণা দেন। একপর্যায়ে পাঁচলাইশ থানার ওসি নাজিম উদ্দিন উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তিনি নিজের সেলফোন বের করে বিক্ষোভকারীদের ভিডিও করেন এবং তাদের পরে দেখে নেবেন বলে হুঁশিয়ারি দেন। এরপর একযোগে সবাই ওসির বিরুদ্ধে হইচই শুরু করেন এবং ভিডিও ডিলিটের দাবি জানান।

গ্রেপ্তার মোস্তাকিমও ওসির সেই মোবাইল সরিয়ে নিতে চেষ্টা করেন। এরই মধ্যে হাতাহাতিতে ওসির মোবাইল মাটিতে পড়ে ভেঙে যায়। এরপর ওসি মোস্তাকিমকে পেটাতে পেটাতে তিনি চমেকের প্রধান ফটকের বিপরীতে এপিক হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানেও তাকে আরেক দফা মারধর করা হয়। কিছুক্ষণ পর এপিকের সামনে থেকে আরও একজনকে ওসি ধরে ভেতরে নিয়ে যান। পাশাপাশি অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেন।

একপর্যায়ে একজনকে ছেড়ে দিলেও মোস্তকিমকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। তবে মোস্তাকিম আন্দোলনে থাকলে তার মা তখনও চমেক হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করাচ্ছিলেন। হাসপাতালে থাকতে তিনি শুনেন তার ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। কান্না করতে করতে তিনি হাসপাতাল থেকে সরাসরি পাঁচলাইশ থানায় চলে যান। সেখানে গিয়েও তিনি পুলিশ কর্মকর্তার মন গলাতে পারেননি।

এরপর ওই দিন রাতে সংঘর্ষের ঘটনায় পাঁচলাইশ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোস্তাফিজুর রহমান বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। এতে আসামি করা হয় মোস্তকিমকে। এছাড়া মামলাটিতে অজ্ঞাতনামা ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করা হয়। এতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলা ও কর্তব্য কাজে বাধা প্রদানের অভিযোগ আনা হয়। মামলাটিতে গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন মোস্তাকিম।

এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে টনক নড়ে চমেক প্রশাসনের। এতদিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে স্যান্ডরের চুক্তির কথা বলা হলেও বুধবার ঢাকা থেকে চমেকে আসে নতুন ডায়ালাইসিস মেশিন। একই সঙ্গে আগে থেকে থাকা মেশিনগুলো রোগীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।

জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে ১০টি মেশিন হাসপাতালে পৌঁছেছে। এসব স্থাপনের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে নতুন একটি মেশিন চালু করা হয়েছে। বাকিগুলো ১৫ দিনের মধ্যে স্থাপন করা যাবে। এছাড়া করোনা ওয়ার্ডের তিনটি এবং নেফ্রোলজি ওয়ার্ডের চারটি মেশিন উন্মুক্ত করা হয়েছে। এগুলোতে রোগীরা প্রতি সেশন ৪১৭ টাকা মূল্যে ডায়ালাইসিস করাতে পারবেন। ইতোমধ্যে গরিব-অসহায় রোগীদের আমরা চিহ্নিত করেছি। তাদের সেবা দেওয়া হবে। পাশাপাশি স্যান্ডরেও ডায়ালাইসিস কার্যক্রম চলবে। নতুন সবগুলো মেশিন চালু হলে রোগীদের ভোগান্তিও কমবে।

সংঘর্ষ ও মামলার পর কেন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এতদিন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে স্যান্ডরের চুক্তির শর্তানুযায়ী মেশিন স্থাপন করা হয়নি। এখন মন্ত্রণালয় তো এসব মেশিন পাঠিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্পের আওতায় ২০১৫ সালে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান স্যান্ডর ম্যাডিকেইডস প্রাইভেট লিমিটেড স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের টেন্ডারে অংশ নেয়। এতে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি ১০ বছরের জন্য কাজ পায়। এরপর বাংলাদেশের জয়েন্ট স্টকে স্যান্ডর ডায়ালাইসিস সার্ভিসেস বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠানটি নিবন্ধিত হয়। এই কোম্পানি ২০১৬ সালের অক্টোবরে জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটে ডায়ালাইসিসের কার্যক্রম শুরু করে। এরপর ২০১৭ সালের ৪ মার্চ চমেক হাসপাতালে কার্যক্রম শুরু করে। হাসপাতালের নিচ তলার একটি অংশে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম উদ্দিন।

চুক্তির শর্তানুযায়ী দুই হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের নির্দেশে স্যান্ডর কিডনি রোগীদের এক বছরে মোট ১৯ হাজার ৫০০ সেশন ভর্তুকি মূল্যে ডায়ালাইসিস করাবে। এর মধ্যে জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটে ১৩ হাজার এবং চমেক হাসপাতালে করা হবে সাড়ে ছয় হাজার। এর চেয়ে বেশি সেশন ভর্তুকি মূল্যে করালে বাকি টাকা মন্ত্রণালয় প্রদান করে থাকে।

প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, ২০১৯-২০২০ সালে এসে দেখা যায় ভর্তুকি মূল্যের এক বছরের নির্ধারিত সেশন কয়েকমাসে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়, যে রোগী আগে মাসের সবকটি সেশন ভর্তুকি মূল্য পেতেন, তাদের অর্ধেক ভর্তুকি এবং বাকি সেশন সম্পূর্ণ টাকা দিয়ে করতে হবে। ২০২৩ সালের শুরুতে এসে আবার চমেক কর্তৃপক্ষ আগের সিদ্ধান্তে ফিরে যায় অর্থাৎ অর্ধেক ভর্তুকি মূল্যে এবং অর্ধেক পুরো টাকা দিয়ে। একই সঙ্গে স্যান্ডরের সঙ্গে চুক্তির শর্তানুযায়ী ভর্তুকি এবং ভর্তুকি ছাড়া উভয় ক্ষেত্রে আগের বছরের তুলনায় পাঁচ শতাংশ করে বাড়ে। এরপর থেকে চমেকে কিডনি রোগীরা আন্দোলনে নামেন।

এসব বিষয়ে কথা হয় স্যান্ডর ডায়ালাইসিস সার্ভিসেস বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেডের সিনিয়র ম্যানেজার (ব্যবসা ও প্রশাসন) মোহাম্মদ মনজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর রাজধানীতে কুর্মিটোলা হাসপাতাল এবং মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরকার ডায়ালাইসিস বন্ধ করে দেয়। এসব হাসপাতালে করোনাভাইরাসের চিকিৎসা দিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই দুই হাসপাতালের কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস সরকার স্যান্ডরে করানোর নির্দেশনা দেন। ওই এক বছর প্রায় ৭৪ হাজারের সেশন ডায়ালাইসিস করিয়েছিলাম। যদিও এসব টাকা মন্ত্রণালয় পরিশোধ করেছে। ওই সময় আমাদের সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে রোগীরা এখনও আমাদের এখানে ডায়ালাইসিস করাতে চান।

তিনি আরও বলেন, রোগীদের অনেকে আমাদের ভুল বোঝেন। সরকার বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ভর্তুকি মূল্য অথবা বেসরকারি মূল্যে আমরা এ কাজ করে থাকি। এক্ষেত্রে বছরে সাড়ে ১৯ হাজারের জন্য চুক্তিবদ্ধ হলেও ঢাকা ও চট্টগ্রামের দুটি সেন্টারে আমাদের প্রায় এক লাখ সেশন ডায়ালাইসিস করানোর সক্ষমতা রয়েছে। নির্ধারিত সেশনের বেশি ভর্তুকি মূল্যে করালে আমরা চুক্তির অতিরিক্ত টাকা মন্ত্রণালয় থেকে পাই। 

এসকেডি